সম্প্রতিকালে মানবজীবনে স্টইকবাদের স্থানকে সম্ভবত কিছুটা খাটো করে দেখা হয়, বিশেষত প্রগতিশীল শিক্ষাবিদগণ খাটো করে দেখে থাকেন। যখন দুর্ভাগ্যের হুমকি আসে, তখন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। আমরা দুর্ভাগ্য এড়িয়ে চলতে পারি কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে অবিচল ধৈর্য নিয়ে আমরা এই দুর্ভাগ্যের মোকাবেলা করব। প্রথম পদ্ধতিটি খুবই শ্রদ্ধেয় যদি ভীরুতা ব্যতিরেকে তা সম্ভব হয়; কিন্তু দ্বিতীয়টিরও দরকার আছে, অবিলম্বে কিংবা কিছুকাল। পরই এর দরকার হবে, অন্তত তার জন্য তো অবশ্যই দরকার, যিনি ভীতির ক্রীতদাসে পরিণত হতে প্রস্তুত নন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই স্টইকবাদ। একজন শিক্ষকের পক্ষে তরুণদের মধ্যে স্টইকবাদ বিস্তার দূরূহ হয়ে পড়ে এজন্য যে এই কাজটি করতে গেলে ধর্ষকাম মুক্তির পথ খুঁজে পায়। অতীতকালে শৃঙ্খলা-সম্পর্কিত ধারণা এতটা হিংস্র ছিল যে, শিক্ষা হয়ে দাঁড়াত নিষ্ঠুরতার প্রতি অনুরাগের সদর রাস্তা। শিশুকে ভোগান্তির শিকারে পরিণত করে আনন্দ লাভ না করে তাদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শৃঙ্খলা শেখানো কি সম্ভব? প্রাচীনপন্থিরা অবশ্য অস্বীকার করে বলবেন, এই কাজটি করে তারা কোন সুখ বোধ করেন না। এই গল্পটা সবাই জানেন; জনৈক পিতা আর পুত্রকে বেত্রাঘাত করার সময় বলেছেন : পুত্র, এতে আমি তোমার চেয়ে বেশি আঘাত পাচ্ছি। পুত্র জবাবে বলেছিল : তাহলে বাবা, তুমি কি এ কাজটি আমাকে করতে দেবে? The Way of all Flesh উপন্যাসে স্যামুয়েল বাটলার কঠোর পিতামাতার ধর্ষকামী সুখের যে চিত্র এঁকেছেন তা আধুনিক মনস্তত্ত্বের যে-কোনো ছাত্র সাগ্রহে গ্রহণ করবেন। তাহলে আমরা এ ব্যাপারে কী করব?
অনেক বিষয়ের মধ্যে মৃত্যু-ভীতি একটি যা আমরা স্টইকবাদের সাহায্যে মোকাবেলা করতে পারি। দারিদ্র্যের ভয় রয়েছে, দৈহিক যন্ত্রণার ভয় রয়েছে, সন্তানের জন্মদানের ভীতিও ধরতে হবে,-এটা ধনবান মহিলাদের মধ্যে খুবই ক্রিয়াশীল। এই সব ভয় ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং এখন কম-বেশি তুচ্ছ গণ্য করা হয়। কিন্তু যদি আমরা এই পথ বেছে নিই যে জনগণের এ ব্যাপারে কিছু মনে করা উচিত হবে না, তাহলে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে এই ঝোঁকও দেখা দেবে যে অকল্যাণ লঘু করার জন্য কিছু করা নিষ্প্রয়োজন। দীর্ঘকাল মনে করা হতো সন্তান জন্মদানের সময় মায়েদের চেতনানাশক (Anaesthetics) কিছু গ্রহণ করা উচিত হবে না। জাপানে এই ধারণা আজ পর্যন্ত টিকে আছে। পুরুষ ডাক্তারগণ অভিমত ব্যক্ত করতেন যে, চেতনা নাশক ক্ষতিকারক। অথচ এই অভিমতের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই, নিঃসন্দেহে এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিল নিশ্চেতন ধর্ষকাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জন্মদানের বেদনা প্রশমিত করা হতে লাগল, ধনাঢ্য মহিলারা বেদনা সহ্য করতে কম ইচ্ছুক হতে লাগলেন, তাদের সাহস প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুতগতিতে হ্রাস পেল। স্পষ্টতঃই একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। গোটা জীবন মখমল-তুল্য এবং সুখকর করা অসম্ভব, সুতরাং মানুষকে এমন মনোভাব গড়ে তুলতে সমর্থ হতে হবে যা জীবনের অপ্রীতিকর পর্যায়ের জন্য উপযুক্ত হবে। তবে আমাদের এটা করতে নিষ্ঠুরতা যথাসম্ভব কম উৎসাহিত করতে হবে।
যাদের বাচ্চা ছেলেদের লালন পালন করতে হয় তারা অতিশীঘ্র শেখেন অতিরিক্ত সহানুভূতি ভ্রমাত্মক। একেবারে কম সহানুভূতি অবশ্য সমধিক ভ্রমাত্মক, কিন্তু এক্ষেত্রে, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই, কোনো চরমপন্থা ভালো নয়। যে শিশু শুধু সহানুভূতি পেতেই অভ্যস্ত যে অতিক্ষুদ্র দুর্ভোগের জন্য সোরগোল তুলবে। গড় পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি সাধারণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন এই জ্ঞানের কল্যাণে যে সোরগোল তুলে সহানুভূতি লাভ করা যাবে না। শিশুরাও অবিলম্বে বুঝতে পারে, যে ব্যক্তি অনেক সময় কিছুটা কঠোর সেই ব্যক্তি তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। সহজাত প্রবৃত্তি তাদের জাগিয়ে দেয়, তাদের ভালোবাসা হচ্ছে কি হচ্ছে না এবং যাদের কাছ থেকে তারা স্নেহ আশা করে তারা যদি শিশুর উপযুক্ত বিকাশের আন্তরিক ইচ্ছা থেকে কঠোরও হন, তবে সে কঠোরতা তারা সহ্য করবে। সুতরাং তত্ত্বগতভাবে সমাধান অত্যন্ত প্রাঞ্জল: ভালোবাসা দ্বারা অনুপ্রাণিত হোন, তারাও সঠিক কাজটি করবে। যাহোক, বস্তুত ব্যাপারটা কিন্তু আরো জটিল। ক্লান্তি, বিরক্তি, অধৈর্য পিতা বা মাতা কিংবা শিক্ষককে আক্রান্ত করতে পারে। অতএব এমন শিক্ষাতত্ত্ব থাকা বিপজ্জনক যেখানে শিশুর চূড়ান্ত কল্যাণের স্বার্থে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি এই অনুভূতিগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। তথাপি এই তত্ত্ব যদি সত্য হয় তবে তা গ্রহণ না করে উপায় নেই এবং বিপদের দিকটা সম্পর্কে পিতা-মাতা কিংবা শিক্ষককে সচেতন করতে হবে, যাতে শিশুদের রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
এতক্ষণ আলোচনার ভেতর আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছি এখন তার সারসংক্ষেপ করা চলে। জীবনের বেদনাদায়ক দুর্ভোগ সম্পর্কে বলা যায়, এ সম্পর্কে জ্ঞান শিশুদের কাছ থেকে আড়াল করা যেমন উচিত হবে না তেমনি অনুচিত হবে তাদের উপর জেদ করে এই জ্ঞান আরোপ করা। এই জ্ঞান আসবে যখন পরিস্থিতি একে অনিবার্য করে তুলবে। বেদনায়ক ঘটনা সততা ও নিরাসক্তির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করা উচিত, তবে পরিবারে কারো মৃত্যু হলে দুঃখ গোপন করা স্বাভাবিক কাজ হবে না। বয়স্ক ব্যক্তিদের উচিত হবে আচরণে জাঁকালো সাহস প্রদর্শন, যা তরুণরা নিশ্চেতনভাবে তাদের উদাহরণ থেকে আয়ত্ত করবে। বয়ঃসন্ধিকালে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে বিশাল কিছু নৈর্ব্যক্তিক স্বার্থ এবং এমনভাবে শিক্ষাদান করতে হবে (ইশারায়, সুস্পষ্ট উপদেশের আকারে নয়) যাতে তারা এই ধারণা লাভ করে যে বেঁচে থাকার লক্ষ্য শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিল নয়। দুর্ভাগ্য সহ্য করার শিক্ষা তাদের দেয়া উচিত; দুর্ভাগ্যে পতিত হলে তারা যেন স্মরণ করতে পারে জীবনে বেঁচে থাকার আরো অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য দুর্ভাগ্য সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত হবে না। দুর্ভাগ্য মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যও তাদের এ নিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়।