যখন আমি ইঙ্গিত দেই যে কাজের সময় কমিয়ে চার ঘন্টা করা উচিত, তখন আমি কিন্তু এটা বোঝাই না যে বাকি সময় অবশ্যই লঘুচিত্ততার ভেতর কাটিয়ে দিতে হবে। আমি বোঝাতে চাই যে দিনে চার ঘণ্টা কাজ করলে একজন মানুষ জীবনের প্রয়োজন এবং প্রাথমিক আরামের জন্য ব্যয় করার মতো সুযোগ ও সময় পাবে, এবং বাকি সময় সে যে ভাবে ইচ্ছে করে সে ভাবে ব্যয় করবে। অনুরূপ সমাজ ব্যবস্থার আবশ্যিক অঙ্গ হলো বর্তমানে শিক্ষাদর্শ যে অবস্থায় আছে তার থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং এই শিক্ষাদর্শ, অংশত, মানুষের রুচি গড়ে তুলবে যাতে সে অবসর সময়টা বুদ্ধির সঙ্গে কাজে লাগাতে পারে। আমি যে ধরনের কাজের কথা প্রধানত ভাবছি তাকে বিবেচনা করা হয় নাক উঁচু। দূর পল্লি অঞ্চল ছাড়া সর্বত্র আজ কৃষক-নৃত্য ইন্তেকাল করেছে, কিন্তু যে তাড়নার জন্য ঐ নৃত্য চর্চা করা হতো তা নিশ্চয় মানব প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যায় নি। শাহরিক জনসংখ্যার আনন্দ প্রধানত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে; সিনেমা দেখা, ফুটবল খেলা দেখা, রেডিও শোনা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর কারণ হলো জনগণের সক্রিয় শক্তিকে কাজ পুরোপুরি গ্রাস করে; তাদের যদি অধিকতর অবসর জুটত তবে তারা পুনরায় আনন্দ উপভোগ করত, যে আনন্দে তারা আগে সক্রিয় অংশ নিয়েছে।
অতীতে অবসরভোগী শ্রেণি ছিল ক্ষুদ্র, কর্মী শ্রেণি ছিল বৃহত্তর। অবসরভোগী শ্রেণি যে সুবিধাদি উপভোগ করতেন তাতে সামাজিক ন্যায় বলতে কিছু ছিল না; ফলে উক্ত শ্রেণি অত্যাচারী হয়ে পড়ে, তাদের সহানুভূতি হয়ে যায় সীমাবদ্ধ, এবং এমন কারণ উদ্ভাবন তাদের করতে হয় যাতে ঐ সুবিধাদি ন্যায্যতা পায়। ফলে এর চমৎকারিত্ব হ্রাস পায়, তবে এই ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, যাকে আমরা সভ্যতা বলি তার প্রায় সবটুকুতেই এটা অবদান রেখেছে। এটা শিল্পকলা চর্চা করেছে। আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানসমূহ; পুস্তক লিখেছে, দর্শনাদি করেছে উদ্ভাবন, এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে করেছে সুন্দর ও সূক্ষ্মতর। এমনকি নির্যাতিতরা যে মুক্তি লাভ করেছে তাও স্বাভাবিকভাবেই উপর থেকে উদ্বোধন করা হয়েছে। অবসরভোগী শ্রেণি না থাকলে মানবতা বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।
উত্তরাধিকার সূত্রে উদ্ধৃত কর্মহীন, অবসরভোগী শ্রেণি অবশ্য ছিল একেবারে অপচয়ী। এই শ্রেণির একটি সদস্যকেও পরিশ্রমী হতে শেখানো হয়নি। এবং শ্রেণিটি সামগ্রিকভাবে অসাধারণ কোনো বুদ্ধিমান ছিল না। এই শ্রেণি একজন ডারুইন জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিপরীতে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ ভদ্রলোকের নামোল্লেখ করা যায় যারা কোনোদিন খেঁকশিয়াল শিকার এবং অবৈধ শিকারিদের শাস্তি প্রদানের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো কাজের কথা চিন্তা করেনি। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যা যোগান দেয়ার কথা, অধিকতর নিয়মবদ্ধভাবে, তা অবসরভোগী শ্রেণি যোগান দিয়েছে কাকতালীয়ভাবে এবং উপজাত হিসেবে। এটা একটা বিরাট উন্নতি, কিন্তু এর নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটিও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বৃহত্তর জগতের জীবন থেকে এতটা পৃথক যে, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবহে বাস করেন তারা সাধারণ নর-নারীর মেজাজ ও সমস্যা ঠিক বুঝতে পারেন না; উপরন্তু তারা তাদের যে স্বাভাবিক নিয়মে বক্তব্য প্রকাশ করেন তাতে সাধারণ জনগণের উপর তাদের মতামতের যে প্রভাব থাকা উচিত ছিল তা থাকে না। অপর একটি অসুবিধা এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা ব্যাপারটা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠভাবে হয়, এবং যারা একটু আলাদাভাবে গবেষণা করার কথা ভাবেন তাদের করা হয় নিরুৎসাহিত। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতটাই দরকারে লাগুক, তার চার দেয়ালের বাইরের জগতের সবাই উপযোগবাদী ধান্দায় খুবই ব্যস্ত বলে প্রতিষ্ঠানগুলো সভ্যতার স্বার্থ সংরক্ষণের উপযোগী অভিভাবকে পরিণত হতে পারে না।
যে জগতে কোনো ব্যক্তি চার ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য নয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাসম্পন্ন প্রত্যেকে তার কাজের সুযোগ পাবেন, প্রত্যেক চিত্রকর কেবল চিত্র এঁকে যাবেন এবং তাকে অনাহারে থাকতে হবে না, তার চিত্রকর্ম যতই চমৎকার হোক না কেন। মহৎ সৃষ্টিকর্মের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে তরুণ লেখকরা রোমাঞ্চকর কেচ্ছা লিখতে বাধ্য হবে না। পেশাগত জীবনে যারা অর্থনীতি কিংবা সরকারের কোনো পর্যায় সম্পর্কে উৎসাহী হয়, তারা প্রাতিষ্ঠানিক নিবিষ্টচিত্ততা ছাড়াও নিজেদের ধারণাকে বিকশিত করতে পারবে। যে নিবিষ্টচিত্ততার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনেক সময় মনে হয় বাস্তবতাবর্জিত। ডাক্তাররা তাদের শাস্ত্রের সর্বশেষ বিকাশ সম্পর্কে খবর রাখার সময় পাবে; শিক্ষকদের, তারা যৌবনে যা শিখেছে, একঘেয়ে পদ্ধতিতে তা ছাত্রদের শেখানোর বিরক্তিকর সংগ্রাম করতে হবে না। তার যৌবনে অর্জিত জ্ঞান ইতোমধ্যে ভুলও প্রমাণিত হয়ে থাকতে পারে।
সর্বোপরি, ক্ষয়ে-যাওয়া স্নায়ু, ক্লান্তি এবং অজীর্ণতার বদলে থাকবে সুখ এবং জীবনে আনন্দ। যতটুকু কাজ করা হবে তা অবসর আনন্দময় করার জন্য হবে যথেষ্ট। কিন্তু অত্যন্ত ক্লান্তি উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে না। যেহেতু মানুষ তাদের অবসর সময়ে ক্লান্তি বোধ করবে না সুতরাং তারা নিষ্ক্রিয় এবং নিরস আমোদ দাবি করবে না। জনসংখ্যার অন্তত এক শতাংশ যে সময় পেশাগত কাজে ব্যয় করেনি তা জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করবে এবং যেহেতু তাদের জীবিকার জন্য উক্ত ধান্দার উপর নির্ভর করতে হবে না ফলে তাদের মৌলিকতা ক্ষুণ্ণ হবে না, এমনকি বৃদ্ধ পণ্ডিতদের দ্বারা নির্ধারিত নীতিমালার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও দরকার করবে না। এই সব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই শুধু অবসরের সুবিধাগুলো লাভ করা যাবে না। সাধারণ নারী-পুরুষ, সুখী জীবনের সুযোগ থাকার দরুন, অধিক দয়াশীল ও কম অত্যাচারী হবে এবং অন্যদের কম সন্দেহের চোখে দেখবে। যুদ্ধের রুচির হবে মৃত্যু, অংশত এই কারণে, অংশত সবাইকে যুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ও কঠোর শ্রম দিতে হবে বলে। সকল নৈতিক গুণাবলির মধ্যে এই জগতের সবচেয়ে বেশি দরকার সৎ স্বভাবের, আর সৎ স্বভাব হলো স্বচ্ছন্দ জীবন এবং নিরাপত্তার ফলশ্রুতি, শ্রমসাধ্য সংগ্রামের ফল নয়। উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি আমাদের সবার জন্য আয়েসি ও নিরাপদ জীবনের সম্ভাবনা সম্ভব করেছে; অথচ আমরা কারো জন্য বেছে নিয়েছি অতিরিক্ত কাজ, আর বাকি লোকদের জন্য বেছে নিয়েছি অনাহার। এতকাল পর্যন্ত আমরা যন্ত্রাদি উদ্ভাবনের আগের সময়ের মতো কঠোর কর্মে লিপ্ত রয়েছি; আর কী নির্বোধের মতোই না আমরা তা করছি; তবে অনন্তকাল বোকা থাকার কোনো যুক্তি নেই।
০২. ‘অকেজো’ জ্ঞান
অধ্যায় ২ – ‘অকেজো’ জ্ঞান