উপযুক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট শিশু বা কিশোরের অভিজ্ঞতা অনুসারে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যদি শিশুটির অতি নিকটের কেউ মারা না যায়, তাহলে মৃত্যুকে সাধারণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা খুবই সহজ হবে। এতে বড় কোনো আবেগগত স্বার্থ জড়িত থাকবে না। মৃত্যু ব্যাপারটা যতক্ষণ বিমূর্ত ও নৈর্ব্যক্তিক, ততক্ষণ এর উল্লেখ করতে হবে অনাসক্ত কণ্ঠে, ব্যাপারটা ভয়ানক, ও রকম কোনো আভাস যেন না মেলে। যদি শিশুটি জিজ্ঞেস করে আমি কি মরব? তাহলে একজনের বলা উচিত হবে, হ্যাঁ, তবে কিছুকালের মধ্যেই নয়। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকার রহস্যময় ধারণা সৃষ্টি হওয়ায় বাধা দিতে হবে। অযোগ্য হয়ে যাওয়া খেলনার পর্যায়ে একে নামিয়ে আনতে হবে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বাঞ্ছনীয় যে তরুণদের কাছে মৃত্যু দূরতম ঘটনা বলে মনে করাতে হবে।
যদি শিশুটির নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ মারা যায়, তাহলে ব্যাপারটা ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে হবে। উদাহরণত, শিশুটির একটি ভাই মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই পিতামাতা অসুখী হবেন এবং যদিও তারা চাইবেন না যে শিশুটি বুঝতে পারুক তারা কতটা অসুখী, তবু এটা সঠিক এবং প্রয়োজনীয় যে ছেলেটা অন্তত কিছু বুঝুক তার পিতামাতার অসুখটা কোথায়। স্বাভাবিক স্নেহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং ছেলেটির অনুভব করা উচিত তার মুরুব্বীরা এটা অনুভব করেন। উপরন্তু, যদি অতিমানবিক প্রচেষ্টায় তারা তাদের দুঃখ ছেলেটির কাছে গোপন রাখেন তবে সে ভাবতে পারে: আমি মারা গেলে তারা কিছুই মনে করবে না। এই ধরনের চিন্তা থেকে মানসিক ব্যাধি বিকাশলাভ করতে পারে। সুতরাং যদিও এ ধরনের ঘটনার আঘাত শৈশবকালের শেষের দিকে পেলে তা ক্ষতির কারণ হয় (প্রথমদিকে খুব বেশি অনুভব করা যায় না)। এবং ঘটলে তার গুরুত্ব আমাদের খুব বেশি খাটো করে দেখা উচিত হবে না। এই বিষয়টি এড়িয়ে চলাও উচিত হবে না, অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানও হবে অন্যায়। অভীষ্ট সম্পর্কে সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে যা কিছু সম্ভব তা অবশ্যই করতে হবে: ছেলেটির মনোযোগ নতুন বিষয়ে আকৃষ্ট করতে হবে, সর্বোপরি নুতনভাবে স্নেহসিক্ত করতে হবে। আমি মনে করি কোনো ছেলের একটি ব্যক্তির প্রতি তীব্র অনুরাগ সবসময়ই কিছু হারানোর চিহ্ন। এই অনুরাগ পিতা-মাতার মধ্যে একজনের প্রতি জাগতে পারে যদি এদের মধ্যে একজনের ভেতর দয়ার অভাব দেখা দেয়, এই অনুরাগ শিক্ষকের প্রতিও জাগতে পারে যদি পিতা-মাতা উভয়ে হন নির্দয়। সাধারণত এটা ভীতি থেকে জন্মে থাকে: অনুরাগের লক্ষ্য তিনিই হন যিনি নিরাপত্তা বোধ জাগাতে পারেন। শৈশবে এই ধরনের অনুরাগ স্বাস্থ্যকর নয়। উক্ত অনুরাগের অস্তিত্ব যেখানে রয়েছে সেখানে যদি ভালোবাসার পাত্র মারা যায় তাহলে ছেলেটির জীবন বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে সবকিছু ভালো মনে হলেও, পরবর্তীকালীন অনুরাগের সঙ্গে আতংক জড়িত হবে। স্বামী (কিংবা স্ত্রী) এবং সন্তানেরা উল্কণ্ঠা-আক্রান্ত হবে। তাছাড়া যখন নিজের জীবন স্বাভাবিকভাবে যাপন করে যাবে, তাদের কাছে মনে হবে হৃদয়হীন। সুতরাং পিতা বা মাতার এ ধরনের অনুরাগের বস্তুতে পরিণত হয়ে খুব উফুল্ল বোধ করা উচিত হবে না। ছেলেটির পরিবেশ যদি হয় স্বাভাবিকভাবে বন্ধুতাপূর্ণ এবং সুখী তাহলে বিয়োগব্যথা অধিক অসুবিধা ছাড়াই উত্তীর্ণ হতে পারবে। জীবনের প্রতি ঝোঁক ও আশাই যথেষ্ট, শর্ত থাকে যে উন্নতি ও সুখের অনুকূলে স্বাভাবিক সুযোগ থাকতে হবে।
কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারে আরো সদর্থক কিছু থাকা দরকার। সাবালক জীবন সন্তোষজনক হওয়ার জন্যই এটা প্রয়োজনীয়। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির উচিত মৃত্যু সম্পর্কে কম ভাবা, কি নিজের কি তার ভালোবাসার পাত্রদের সম্পর্কে, এজন্য নয় যে সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার চিন্তা ভিন্ন পথে পরিচালিত করবে, কারণ তা হবে অকেজো প্রচেষ্টা, যা বাস্তবে কোনোদিন সফল হয় না। বস্তুত এটা করতে হবে তার কৌতূহল ও কার্যক্রমের বিভিন্নমুখিনতার জন্য। যখন তিনি মৃত্যু সম্পর্কে ভাববেন, প্রকৃষ্ট কাজ হবে স্টয়িকসুলভ ঔদাসীন্য সহকারে তা ভাবা, ইচ্ছাকৃত এবং সুস্থিরভাবে, ব্যাপারটার গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা এতে থাকবে না। বরং ব্যাপারটার উর্ধ্বে ওঠার নির্দিষ্ট গর্বানুভব এত কাজ করবে। নীতিটা হবে অপরাপর যে-কোনো আতংক থেকে অভিন্ন সম্ভাব্য চিকিৎসা হলো আতংকজনক বস্তু সম্পর্কে দৃঢ়সংকল্প অনুধ্যান। কেউ মনে-মনে বলতে পারেন: আচ্ছা হা, যদি তা ঘটেই যায় তাহলে কি ই বা হলো? লোকেরা যুদ্ধে মৃত্যুর মতো ঘটনায় এই মনোভাব অর্জন করে, কারণ ঐ সময় তাদের নিশ্চিত ভাবে বোঝানো হয় যে তারা একটা লক্ষ্যের জন্য তাদের কিংবা প্রিয়জনের জীবন উৎসর্গ করেছে। এই ধরনের উপলব্ধি সবসময়ই কাম্য। সবসময়ই একজনকে ভাবতে হবে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জন্য তিনি বেঁচে আছেন এবং তার মৃত্যু, তার স্ত্রী কিংবা সন্তানের মৃত্যু জগৎ সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহের পরিসমাপ্তি ঘটায় নি। সাবালক জীবনে এই মনোভাব আন্তরিক এবং গম্ভীর হতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে একজন তরুণের উচিত উদার উৎসাহে আপুত হওয়া এবং তার জীবন ও বৃত্তি সেই মোতাবেক উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। বয়ঃসন্ধি ঔদার্যের পর্যায়কাল; এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে উদার অভ্যাস গড়ার জন্য। পিতা কিংবা শিক্ষকের প্রভাবে এটা অর্জন করা যেতে পারে। উন্নততর সমাজে মায়েরাই অনেক সময় এটা করতে পারেন; কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় মহিলাদের জীবন এমন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং আমি যতটা বিদগ্ধ হওয়া উচিত মনে করি তা হয় । একই কারণে নব্য যুবকদের (যুবতিদেরও) পুরুষ শিক্ষকের সঙ্গ পাওয়া উচিত। যতক্ষণ না এক নতুন শ্রেণির মহিলার আবির্ভাব ঘটে যারা আগ্রহের দিক থেকে অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক।