সে যাই হোক, এই প্রত্যেকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আমার আপত্তি রয়েছে। আবেগগত কৌতূহলের কোনো বিষয় সম্পর্কে ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা, যৌনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রয়েডপন্থিরা যেমন উল্লেখ করেছেন, অসফল হতে বাধ্য, এবং এর পরিণাম দাঁড়ায় নানা ধরনের অবাঞ্ছনীয় বিকৃতি বা বিচ্যুতি। এখন অবশ্যই একটি বাচ্চা ছেলের জীবন থেকে মৃত্যু-চেতনা সরিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। এটি ঘটে কি ঘটে না, তা ভাগ্যের ব্যাপার। যদি বাবা বা মা, ভাই বা বোন মারা যায়, তাহলে এমন কোনো উপায় নেই কিংবা কিছু করার থাকে না যাতে একটি বাচ্চা ছেলের মৃত্যু সম্পর্কে আবেগগত সচেতনতা অর্জনে বাধা দেওয়া যায়। এমনকি যদিও, ভাগ্যগুণে, একটি ছেলের প্রথম জীবনে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা স্বচ্ছ নাও হয়, শীঘ কিংবা বিলম্বে সে এই সচেতনতা অর্জন করবে; এবং যারা এ বিষয়ে একেবারেই অপ্রস্তুত তারা সচেতন হওয়ার পরই খুব সম্ভব অত্যন্ত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। অতএব মৃত্যুকে এড়িয়ে না গিয়ে, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।
আবার বিরামহীনভাবে মৃত্যু-চিন্তার অভ্যাস অন্তত সমান ক্ষতিকর। কোনো একটা বিষয়ে খুবই একান্তভাবে চিন্তা ভুল, বিশেষত যখন আমাদের চিন্তা কার্যে পরিণত হতে পারে না। অবশ্য আমরা মৃত্যু মুলতবি রাখতে চেষ্টা করতে পারি, এবং সীমাবদ্ধতার ভেতর যে-কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি তা করে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারি না। অর্থাৎ এটি একটি লাভহীন চিন্তার বিষয়। উপরন্তু এটি একজন মানুষের অপরের প্রতি এবং ঘটনাবলির প্রতি কৌতূহল হ্রাস করে এবং বস্তুগত কৌতূহলই শুধু মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে পারে। মৃত্যু-ভয় মানুষকে এই বোধ তাড়িত করে যে সে বাহ্যিক শক্তির দাস, এবং দাস মনোবৃত্তি থেকে সুফল আসতে পারে না। যদি কোনো ব্যক্তি গভীর ধ্যান করে সত্যিই মৃত্যু ভয় থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারেন, তাহলে তিনি এ বিষয়ে ভাবনায় ক্ষান্তি দেবেন। যতক্ষণ তিনি এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকবেন, তা প্রমাণ করবে যে তিনি মৃত্যু ভয় ছাড়তে পারেন নি। অতএব এই পদ্ধতি অন্য পদ্ধতি থেকে উন্নততর নয়।
মৃত্যু উন্নততর জীবনের দরোজা, এই বিশ্বাসে, যৌক্তিকভাবে, যে-কোনো ব্যক্তির যে-কোনো প্রকার মৃত্যু-ভয় বন্ধ করা উচিত। ডাক্তারি পেশার জন্য সৌভাগ্য যে বস্তুত এ ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা এর মধ্যে ধরা হচ্ছে না। কেউ কি দেখতে পান, যারা মৃত্যুকে চরম পরিণতি মনে করেন তাদের চেয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা অসুখ-বিসুখ ব্যাপারে কম ভীত কিংবা যুদ্ধে অধিকতর সাহসী। স্বৰ্গত এফ, ডব্লু. এইচ, মাইয়ার্স বলতেন, তিনি কীভাবে এক নৈশ ভোজনোৎসবে জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃত্যুর পর তার কী পরিণতি হবে বলে তিনি মনে করেন। ঐ ব্যক্তি প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু চাপ প্রয়োগ করা হলে জবাব দেন, ও হ্যাঁ, আমি চিরন্তন আশীর্বাদের উত্তরাধিকারী হবো, কিন্তু আমি আশা করব আপনি এ ধরনের অপ্রীতিকর বিষয়ে কথা বলবেন না। অবশ্যই এ ধরনের পরিষ্কার অসংলগ্নতার কারণ হলো ধর্মীয় বিশ্বাস শুধু অধিকাংশ মানুষের সজাগ চিন্তায় অস্তিত্বশীল, এবং কোনো মতেই মানুষের নিশ্চেতন কার্যকারিতা সংশোধন করতে সফল হয়নি। মৃত্যু-ভয় সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে, তা করতে হবে কতকগুলো পদ্ধতিতে, যা সামগ্রিকভাবে মানবিক আচরণ প্রভাবিত করে, শুধু, যাকে আমরা সাধারণভাবে বলি সজাগ-চিন্তা, আচরণের সেই অংশ প্রভাবিত করলে চলবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব কাজ করতে পারে, কিন্তু মানবজাতির সংখ্যাগুরু এই প্রভাবের বাইরে থাকবে। আচরণগত যুক্তি ছাড়াও এই ব্যর্থতার আরো দুটি উৎস রয়েছে: একটি হলো আন্তরিক ধর্মানুরাগী হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু সন্দেহ থেকে যায়, এবং এটা সংশয়বাদীদের মধ্যে ক্রোধের আকারে প্রকাশ পায়; অপর কারণটি হলো, ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা, তাদের বিশ্বাস যদি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, তাহলে মৃত্যুর সঙ্গে যে-আতংক জড়িত হবে তার মাত্রা কমানোর চেয়ে বাড়িয়ে দেয়, ফলে যারা এ ব্যাপারে সর্বাত্মক নিশ্চিত বোধ করেন না তাদের ভীতি বৃদ্ধি পায়।
তাহলে, অতঃপর, আমরা তরুণদের এই জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কী করব, যেখানে মৃত্যু বাস্তব ঘটনা? আমাদের তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং এই লক্ষ্য তিনটি মেলানো কঠিন কাজ। ১. আমরা অবশ্যই তাদের মধ্যে এমন কোনো বোধ অনুপ্রাণিত করব না যে মৃত্যু এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে ইচ্ছা করি না, কিংবা এ ব্যাপারে ভাবতে তাদের উৎসাহিত করি না। এ ধরনের বোধ যদি আমরা তাদের মধ্যে অনুপ্রাণিত করি তাহলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে এর মধ্যে একটা মজাদার রহস্য রয়েছে, এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবতে শুরু করবে। এক্ষেত্রে যৌনশিক্ষা ব্যাপারে সুপরিচিত যে আধুনিক অবস্থান, তা প্রযোজ্য। ২. তথাপি, আমরা অবশ্যই, যদি সম্ভব হয়, এমন কাজ করবো যাতে তাদের অধিক এবং ঘন-ঘন মৃত্যু নিয়ে ভাবনা থেকে বিরত রাখা যায়। মৃত্যুভাবনা নিয়ে নিমগ্ন থাকার প্রতি এক ধরনের আপত্তি রয়েছে, যে ধরনের আপত্তি তোলা হয় নোংরা পুস্তকে (Pornography) নিয়ে নিমগ্ন থাকার ব্যাপারে। কারণ, এতে দক্ষতা হ্রাস পায়, সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয়, এবং এমন আচরণে অভ্যস্ত করে যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং অপরের জন্যও সন্তোষজনক নয়। ৩. আমরা অবশ্যই কারো মধ্যে শুধুমাত্র সচেতন চিন্তা দ্বারা মৃত্যু বিষয়ে সন্তোষজনক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করার আশা করবো না; বিশেষত, এই বিশ্বাস থেকে কোনো কল্যাণ হয় না যে মৃত্যু কম ভয়ংকর (অন্যকিছু হওয়ার চেয়ে), যেহেতু (স্বাভাবিকভাবেই) ঐ ধরনের বিশ্বাস সচেতনতার নীচু স্তরে অনুপ্রবেশ করতে পারে না।