আমি মনে করি না যে শিক্ষাবিদগণ স্বাধীনতার ঈঙ্গিত কাঠামোর সঙ্গে দরকারি ন্যূনতম নৈতিক প্রশিক্ষণের মিলনের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। স্বীকার্য যে, সঠিক সমাধান অভিভাবকরাই অসম্ভব করে তোলেন সন্তানদের সংস্কৃতিবান স্কুলে ভর্তি করার আগেই। মনঃসমীক্ষকরা যেমন রোগসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আমরা সবাই উন্মাদ, অনুরূপভাবে আধুনিক স্কুলের কর্তারা, অভিভাবকদের দ্বারা বিশৃঙ্খল হওয়া ছাত্রদের সংশ্রবে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে সব শিশু দুরূহ প্রকৃতির এবং অভিভাবকরা একেবারে নির্বোধ। অভিভাবকদের অত্যাচারে যেসব ছেলে বন্য হয়ে গেছে তাদের দীর্ঘ কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার, তবেই তারা বয়স্কদের নিঃসন্দিগ্ধ মনে করবে। কিন্তু যাদের সঙ্গে গৃহে বিজ্ঞতার সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে তারা তদারকি সহ্য করবে। এই শিশুদের বোধ করতে হবে যে তাদের এমন ব্যাপারে সাহায্য করা হচ্ছে যে ব্যাপারকে তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে বয়স্ক ব্যক্তি শিশুদের পছন্দ করেন এবং শিশুদের সাহচর্যে স্নায়ুর চাপ বোধ করেন না তারা শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারেন এবং তা পারেন শিশুদের বন্ধুতাপূর্ণ অনুভূতি না হারিয়ে।
আমার মনে হয় আধুনিক শিক্ষাতাত্ত্বিকরা শিশুদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নঞর্থক দিকের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী, পক্ষান্তরে শিশুদের সাহচার্য উপভোগের সদর্থক দিকের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদানে আগ্রহী। আপনার যদি শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগ থাকে যে ধরনের অনুরাগ দেখা যায় অনেক লোকের ঘোড়া ও কুকুরের প্রতি, তবে তারা আপনার ইংগিতে সাড়া দেবে, বিধিনিষেধ মানবে, হয়তো কিছুটা আনন্দদায়ক অসন্তোষের সঙ্গে। কিন্তু কিছুতেই ক্ষুব্ধ হবে না। শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগের কোনো মূল্য নেই যেখানে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র কিংবা ক্ষমতালিপ্সা প্রকাশের সুযোগ গণ্য করা হয়। কোনো শিশুই কৃতজ্ঞ বোধ করবে না যদি তার প্রতি উৎসাহের উৎস হয় আপনার দলের জন্য ভোট লাভ কিংবা রাজা বা দেশের জন্য তাদের উৎসর্গ করা। ঈপ্সিত অনুরাগ হলো শিশুদের মেলায় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, এবং কোনো অন্তর্গত অভীষ্ট না-থাকা। এই গুণ যে শিক্ষকের রয়েছে তার শিশুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের দরকার করবে না, এবং প্রয়োজনে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন না করেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।
দুর্ভাগ্যবশত, কর্মভারাক্রান্ত একজন শিক্ষকের পক্ষে শিশুদের প্রতি হৃদোখিত অনুরাগ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তার অনুভূতি দাঁড়ায় প্রবাদের ময়রার মতো; মিষ্টির প্রতি ময়রার যে অনুভূতি, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের অনুভূতির সঙ্গে তার তুলনা চলে। আমি মনে করি না যে শিক্ষা কারো একান্ত পেশা হওয়া উচিত: এই পেশায় নিয়োজিত হবে তারা যারা দুঘণ্টা শিক্ষকতা করে বাকি সময় ছাত্রদের থেকে দূরে কাটাবেন। যুবকদের সমাজ খুবই ক্লান্তিকর, বিশেষত যখন কঠোর শৃঙ্খলা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ক্লান্তি বা শ্রান্তি পরিশেষে জন্ম দেয় বিরক্তির, যা এক সময় কোনো না কোনোভাবেই প্রকাশিত হবেই, পেরেশান শিক্ষক নিজেকে যে তত্ত্বেই গড়ে তুলুন না কেন। প্রয়োজনীয় বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি কেবল আত্মসংযম দ্বারা রক্ষা করা যায় না। কিন্তু যেখানে এটা বর্তমান, সেখানে আগে থেকে দুষ্টু ছেলের প্রতি আচরণের নিয়ম রাখা নিষ্প্রয়োজনীয়, যেহেতু আবেগ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যে-কোনো সিদ্ধান্ত সঠিক হবে যদি সে অনুভব করে আপনি তাকে পছন্দ করেন। কোনো নিয়মই, যতই বিজ্ঞতাপূর্ণ হোক, স্নেহ কিংবা বিচক্ষণতার বিকল্প হতে পারে না।
১৩. স্টয়িসিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য
আগে যেখানে অনেক শিক্ষাগত সমস্যার সুরাহা (খুবই অসফলভাবে) করা হতো নিছক নৈতিক শৃঙ্খলা দ্বারা, সেসব সমস্যা এখন আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে আরো অপ্রত্যক্ষভাবে কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাধা করা হয়। বিশেষত মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান সীমিত তারা মনে করেন স্টয়িক আত্ম-পরিচালনার কোনো দরকার নেই। আমি এই মতের অনুসারী নই। বর্তমান নিবন্ধে আমার অভিপ্রায় হলো যেসব পরিস্থিতি একে দরকারি করে তোলে এবং যেসব পদ্ধতিতে এটা তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করা যায় তা বিবেচনা করা; এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য কিছু বিপদ এড়ানোর উপায়ও বিবেচনা করতে চাই।
আমরা এখনি সবচেয়ে দুরূহ এবং সবচেয়ে দরকারি সমস্যা নিয়ে নিবন্ধের সূচনা করব। এই সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার স্টয়িসিজম: আমি মৃত্যুর কথা বলছি। বিভিন্ন উপায়ে মৃত্যু-ভয় মোকাবেলার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা একে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারি; আমরা কখনো এর উল্লেখ পর্যন্ত না করতে পারি, এবং সবসময়ই মৃত্যু-চিন্তা এলে আমাদের ভাবনা ভিন্নমুখী করতে পারি। ওয়েলসের টাইম মেশিনের প্রজাপতি জনগণের পদ্ধতি এটাই ছিল। কিংবা আমরা উল্টো পথও অবলম্বন করতে পারি এবং বিরামহীনভাবে মানবজীবনের স্বল্পায়ু সম্পর্কে ভাবতে বা ধ্যান করতে পারি, এই আশায় যে অতি-পরিচয় অবজ্ঞা জন্ম দেবে; পঞ্চম চার্লস সিংহাসন ত্যাগের পর নিভৃত জীবনে এই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। কেমব্রিজের একটি কলেজের জনৈক ফেলো এতদূর গিয়েছিলেন যে নিজের কক্ষে শবাধার নিয়ে ঘুমাতেন এবং ঐ কলেজের চত্বরে কোদাল নিয়ে যেতেন কৃমি দ্বি-খণ্ড করার জন্য। এবং নির্ভুলভাবে বলতেন: হয়েছে! তুমি এখনও আমাকে ধরতে পারনি। তৃতীয় একটি পন্থাও রয়েছে, এই পন্থাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, পন্থাটি হলো নিজেকে এবং অপরকে বোঝানো যে মৃত্যু মৃত্যু নয়। বরং মৃত্যু হলো নতুন ও উন্নততর জীবনের দরোজা। এই তিনটি পন্থা, বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত হয়ে অধিকাংশ মানুষকে এই আপসে পৌঁছায় যে অস্বাচ্ছন্দকর বাস্তবতা হলো মৃত্যু।