আমেরিকা মনুষ্য-নির্মিত জগৎ; উপরন্তু এই জগৎ মানুষই তৈরি করেছে যন্ত্রের সাহায্যে। আমি কেবল ভৌত পরিবেশের কথা ভাবছি না, সমভাবে চিন্তা এবং আবেগ সম্পর্কেও ভাবছি। একবার ভাবুন তো বাস্তবিক ভয়াবহ একটা খুনের কথা; খুনীর পদ্ধতি আদিকালের হতে পারে, কিন্তু যারা খুনের তথ্য প্রচারিত করে তারা সাহায্য গ্রহণ করে বিজ্ঞানের সর্বশেষ উৎস বা উদ্ভাবনের। শুধু বৃহৎ নগরগুলো নয়, প্রেইরি অঞ্চলের নির্জন খামার এবং রকি অঞ্চলের খনির আখড়ায় রেডিও সর্বশেষ সকল তথ্য প্রচার করে, ফল দাঁড়ায় এই যে, যে কোনো দিন দেশের প্রত্যেক বাড়িতে আলাপ আলোচনার অর্ধেক বিষয় হয় অভিন্ন। ট্রেনে সমতলভূমি অতিক্রমের সময়, লাউডস্পীকার থেকে সাবানের বিজ্ঞাপন শোনা যাচ্ছিল, আমি না শোনার চেষ্টা করছিলাম, এক বৃদ্ধ কৃষক আমার কাছে এসে হাসি মুখে বললেন, আপনি যেখানেই যান না কেন সভ্যতা এড়াতে পারবেন না। হায়! কি সত্য কথা। আমি ভার্জিনিয়া উলফের একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে দিনের জন্য বিজ্ঞাপনের জয় হলো।
জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের অনুষঙ্গাদির অনুরূপতা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু ভাবনা ও অভিমত যদি অভিন্ন হয় সেটা হবে অধিকতর বিপজ্জনক। তবে এটা আধুনিক উদ্ভাবনসমূহের অনিবার্য ফল। বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র আকারে উৎপাদনের চেয়ে সম্মিলিতভাবে এবং বিরাট পরিমাণে উৎপাদন করতে গেলে অনেক সস্তা পড়ে। এটা যেমন অভিমত উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য সামান্য পিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে। আজকের দিনে অভিমত উৎপাদনের প্রধান উৎসসমূহ হলো বিদ্যালয়, গির্জা, পত্র-পত্রিকা, সিনেমা এবং রেডিও। যন্ত্রপাতির ব্যবহার যত বাড়বে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষা ততই প্রমিত হবে। ধরে নেয়া যায় যে নিকট ভবিষ্যতে স্কুল শিক্ষায় সিনেমা এবং রেডিও-র ব্যবহার দ্রুত গতিতে বাড়বে। এর অর্থ হলো একটা কেন্দ্রে পাঠ তৈরি করা হবে এবং যেখানে উক্ত কেন্দ্রের পণ্য ব্যবহার করা হবে সেখানে পাঠ হবে অভিন্ন। আমি শুনেছি কোনো কোনো গির্জা আদর্শ ধর্মোপদেশ অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত যাজকদের কাছে প্রতি সপ্তাহে প্রেরণ করে, এবং এই যাজকরা যদি মানব প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে চলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা কৃতজ্ঞ বোধ করেন যে তাদের নিজেদের ধর্মোপদেশ তৈরির জন্য কষ্ট করতে হলো না। এই আদর্শ ধর্মোপদেশ অবশ্যই ঐ সময়ের তাজা বিষয়ের উপর আলোকপাত করে, লক্ষ্য হলো দেশের সর্বত্র একই গণআবেগ জাগ্রত করা। এই একই ব্যাপার উচ্চমাত্রায় সংবাদপত্রের বেলায় খাটে। সংবাদ সর্বত্র টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আসে এবং ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হয়। পুস্তক সমালোচনা, শ্রেষ্ঠ পত্রিকাদি বাদে, নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রানসিসকো, মেইন থেকে টেক্সাসে, একই। তবে একটা ব্যতিক্রম; আপনি যতই উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবেন দেখতে পাবেন সমালোচনার পরিসর ছোট হয়ে আসছে।
সম্ভবত আধুনিক জগতে অনুরূপতা সৃষ্টির সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে সিনেমা, কারণ সিনেমার প্রভাব শুধু মার্কিন মুলুকে সীমাবদ্ধ নয়। এর অবাধ অনুপ্রবেশ জগতের সর্বত্র। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে ধরতে হবে। তবে এখানে আলাদা জাতের অনুরূপতা রয়েছে। বিস্তৃত অর্থে, মিডল ওয়েস্ট কি পছন্দ করে সে সম্পর্কে হলিউডের অভিমত সিনেমায় রূপদান করা হয়। এই ব্যবস্থাপত্রের আলোকে প্রেম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের আবেগ প্রমিত হচ্ছে। জগতের সর্বত্র তরুণের কাছে আধুনিকতা সম্পর্কে শেষ কথার প্রতিনিধিত্ব করে হলিউড। একই সঙ্গে হলিউড তুলে ধরে ধনী ব্যক্তিদের সুখ এবং কীভাবে ধনবান হওয়া যায় তার পদ্ধতি। অনুমান করছি, অদূর ভবিষ্যতে সিনেমা সার্বজনীন একটা ভাষা অবলম্বনে বাধ্য করবে এবং সেই ভাষাটা হবে হলিউডের।
আমেরিকার অপেক্ষাকৃত অধিক অজ্ঞদের মধ্যে শুধু অনুরূপতা রয়েছে মনে করলে ভুল হবে। এই ব্যাপারটা খাটে, একটু কম মাত্রায় হলেও, সংস্কৃতির বেলায়। আমি ঐ দেশের সর্বত্র বইয়ের দোকান দেখতে গেছি, লক্ষ্য করেছি সব দোকানেই এই বেস্ট সেলার প্রাধান্য পেয়েছে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার মনে হয়েছে যে আমেরিকার সংস্কৃতিবান মহিলারা প্রতি বছর ডজন খানেক বই কেনে, এবং ঐ এক ডজন পুস্তকই সর্বত্র বিক্রি হয়। কোনো লেখকের কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত সন্তোষজনক, অবশ্য তিনি যদি ঐ এক ডজন পুস্তকের একটির লেখক হন। কিন্তু এখানে ঘটনা ইউরোপ থেকে আলাদা। ইউরোপে অনেক বই, বিক্রি কম: গুটিকয় বই, বিক্রি অধিক এমন নয়।
আবার এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে অনুরূপতার প্রতি ঝোঁক একেবারে খারাপ কিংবা একেবারে ভালো। এর সুবিধা অসুবিধা দুই-ই রয়েছে; অবশ্যই এর প্রধান সুবিধা হলো এতে এমন জনগোষ্ঠী তৈরি হয় যারা শান্তিপূর্ণভাবে সহযোগিতার পরিবেশে বাস করতে সমর্থ। এর বড় অসুবিধা এখানে যে এটা যে জনগোষ্ঠী তৈরি করে তার প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘু অত্যাচারের। এই ত্রুটি হয়তো সাময়িক, কারণ অদূর ভবিষৎতে সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকবে না। অবশ্য অনেকটা নির্ভর করে অনুরূপতা কীভাবে অর্জন করা হয় তার উপর। একটা উদাহরণ নেয়া যাক; দক্ষিণ ইতালিবাসীদের প্রতি স্কুলগুলো কী করছে। গোটা ইতিহাস জুড়ে দক্ষিণ ইতালিয়াবাসীরা খুন, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন এবং নান্দনিক সংবেদনশীলতার জন্য বিশিষ্ট। পাবলিক স্কুলগুলো কার্যকরীভাবে এই তিনটির শেষটি থেকে তাদের আরোগ্য করে, এবং এ ক্ষেত্রে তাদের আমেরিকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনুরূপ করে তোলে, কিন্তু বাকি দুটি সুস্পষ্ট গুণ ব্যাপারে স্কুলগুলো চিহ্নিত করার মতো কোনো সাফল্য দেখাতে পারে না। এতে অনুরূপতা লক্ষ্য হওয়ার বিপদগুলোর একটি উপলব্ধি করা যায়; অসদগুণের চেয়ে সদগুণ বিনষ্ট করা সহজতর, সুতরাং মান কমিয়ে দিয়ে সহজেই অনুরূপতা অর্জন করা সম্ভব। অবশ্য এটা পরিষ্কার, যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী বৈদেশিক সেখানে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বিদেশাগতদের ছেলেমেয়েদের গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা নেয়া হবেই এবং ফলে নির্দিষ্ট মাত্রায় মার্কিনীকরণ অবশম্ভাবী। সে যাই হোক, দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, এই প্রক্রিয়ার একটা বড় অংশ নগ্ন জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হবে। আমেরিকা ইতঃমধ্যেই জগতের সবচেয়ে শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে, এবং দেশটির প্রাধান্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এতে স্বভাবতই ইউরোপে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে এবং সবকিছু সমরতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী লক্ষণাক্রান্ত বলে ভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার হয়তো দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে ইউরোপকে রাজনৈতিক সদবুদ্ধি প্রদান, তবে আমি আশংকিত যে তার ছাত্ররা অবাধ্য প্রমাণিত হবে।