বর্তমানে, সম্ভবত এসবই করা হয় কল্যাণের জন্য। একটা মস্ত বড় দেশ, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, উন্নতির জন্য অপেক্ষা করে আছে এবং ঋণ খুব কম ব্যবহার করে উন্নতি করতে হবে।-এই পরিস্থিতিতে কঠোর শ্রম দরকার করে। এবং সম্ভবত বিরাট পুরস্কার অর্জন করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় কাজ না করে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছা যায় যেখানে সবাই আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারবে, তখন কী হবে?
প্রতীচ্যে এই সমস্যার মোকাবেলা আমরা নানাভাবে করতে পারি। অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমাদের মধ্যে নেই, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনের বৃহৎ অংশ জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশের ভোগে চলে যায়। এদের অনেকে মোটই কোনো কাজ করে না। উৎপাদনের উপর কোনো প্রকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে, আমরা এত বেশি উৎপাদন করি যার কোনো দরকার নেই। আমরা কর্মী-জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে অলস রাখি, কারণ তাদের বদলে অন্যদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিতে পারি। আবার যখন এই সব পদ্ধতিই অপূর্ণ প্রমাণিত হয়, তখন আমরা মুখোমুখি হই যুদ্ধের; বহু লোককে আমরা উচ্চতর বিস্ফোরক পদার্থ প্রস্তুতে লাগাই। আরো অনেককে নিয়োজিত করি বিস্ফোরণে, যেন আমরা এমন শিশু, যে এই মাত্র আবিষ্কার করেছে আতশবাজি। এইসব উপায়ের সম্মিলনে, কঠিন হলেও, আমরা ব্যবস্থা করি এই মনোভাব বজায় রাখতে যে কঠোর কায়িক শ্রম গড়ে মানুষের বিধিলিপি।
রুশদেশে অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিচার এবং উৎপাদনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্যাটা ভিন্ন উপায়ে সমাধান করতে হবে। যৌক্তিক সমাধান এই হবে যে, যত শীঘ্র সম্ভব প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন এবং সবার জন্য প্রাথমিক আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করার পর, শ্রমের স্থিতিকাল ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা, এবং প্রতিটি স্তরে সার্বজনীন ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অধিক অবসর এবং অধিক সামগ্রীর মধ্যে কোনটার প্রতি পক্ষপাতী হতে হবে। তবে এতকাল কঠোর শ্রম সর্বাধিক পুণ্যবান গণ্য করার শিক্ষা প্রদানের পর, কর্তৃশ্রেণির পক্ষে কঠিন হবে এমন স্বর্গ নির্মাণ করা যেখানে অবসর থাকবে বেশি কাজ হবে কম। সম্ভবত তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, যে পরিকল্পনার বদৌলতে চলতি অবকাশ ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতার জন্য পরিত্যাগ করা হবে। রুশ প্রকৌশলীদের প্রস্তাবিত একটি সরল পরিকল্পনা সম্প্রতি পাঠ করলাম, উক্ত পরিকল্পনায় শ্বেতসাগর এবং সাইবেরিয়ার উত্তর উপকূল উষ্ণ রাখার কথা বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে কারা সাগর (Kara Sea) বরাবর বাঁধ নির্মাণ করে। এটি একটি খুবই শ্রদ্ধেয় প্রকল্প, তবে এজন্য সর্বহারাদের একটি প্রজন্মের আয়েশ জলাঞ্জলি দিতে হবে, আর আর্কটিক সমুদ্রের বরফ-ক্ষেত্র এবং তুষার ঝড়ের মধ্যে শ্রমের মহত্ত্ব হবে প্রদর্শিত। এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে সেটা হবে কঠোর শ্রমের পুণ্যকে উদ্দেশ্য গণ্য করার ফলাফল। তাহলে শ্রম জিনিসটা এমন পর্যায়ে পৌঁছার উপায় আর থাকবে না যখন শ্রমের আর দরকার করবে না।
ব্যাপারটা হলো, বস্তু চারপাশে নড়াচড়া করা আমাদের অস্তিত্বের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে দরকার হলেও, তা মানব জীবনের অন্যতম উপেয় নয়। ঘটনা তাই হলে প্রত্যেক অদক্ষ শ্রমিককে শেক্সপিয়রের চেয়ে উন্নত বিবেচনা করা হতো। দুটি কারণে আমরা এক্ষেত্রে বিপথে চালিত হয়েছি। একটি হলো দরিদ্র সাধারণকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজনীয়তা, এজন্যই হাজার হাজার বছর ধরে ধনীরা পরিচালিত হয়েছেন শ্রমের মর্যাদা প্রচারে, অবশ্য এক্ষেত্রে মর্যাদাহীন থাকার জন্য নিজেরা অত্যন্ত যত্ন নিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণটি হলো যন্ত্রের প্রতি নতুন আনন্দ। এর দ্বারা আমরা পৃথিবীর উপরিভাগে বিস্ময়কর চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রফুল্ল বোধ করি। এর কোনো একটি উদ্দেশ্যই প্রকৃত কর্মীর কাছে বড় ধরনের আবেদন রাখে না। আপনি যদি এদের একজনকে জিজ্ঞেস করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ কোনটি, তিনি সম্ভবত উত্তর দেবেন নাঃ আমি কায়িকশ্রম খুব উপভোগ করি, কারণ এতে অনুভব করতে পারি যে আমি মানুষের মহত্তম কর্ম সিদ্ধি করছি। আরো এই কারণে যে, আমি ভাবতে ভালোবাসি মানুষ এই গ্রহ কতটা রূপান্তরিত করতে পারে। সত্য যে, দেহের জন্য মাঝে মাঝে বিশ্রামের দরকার রয়েছে, আমাকে তা যতটা সম্ভব শ্রেষ্ঠ উপায়ে পূরণ করতে হবে। কিন্তু যখন সকাল আসে এবং আমি কর্মস্থলে ফিরে যাই, যেখানে রয়েছে আমার সন্তুষ্টির উৎস, তখন যে সুখ পাই, তা আর কখনো জোটে না। আমি কখনো কর্মজীবীদের এ ধরনের কথা বলতে শুনিনি। তারা কাজকে কাজের মতোই বিবেচনা করে জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপায় হিসেবে এবং অবসর সময়েই তারা যতটা সম্ভব সুখ উপভোগ করে।
এরপরও বলা হবে, কিছুটা অবসর আনন্দদায়ক হলেও, লোকেরা জানবে না চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কেবল চার ঘণ্টা কাজ করে বাকি সময়টা কী করে কাটানো যায়। আধুনিক জগতে এটা কিছুটা সত্য হলেও আমাদের সভ্যতার জন্য নিন্দাবাদ ছাড়া কিছু নয়; আগের যুগের জন্য এটা সত্য হতো না। আগে হালকা চালচলন এবং খেলাধুলার সুযোগ ছিল যার কিছুটা দক্ষতার মতবাদ দ্বারা নিষেধ করা হয়েছে। আধুনিক মানুষ মনে করেন যে সবকিছু করতে হবে অপর কিছুর স্বার্থে, এবং কখনো উক্ত কাজের স্বার্থে নয়। উদাহরণত গুরু-গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সব সময়ই সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভ্যাসকে নিন্দাবাদ জানাচ্ছেন এবং আমাদের বলছেন যে সিনেমা দেখার অভ্যাস তরুণদের অপরাধকর্মে প্রলুব্ধ করছে। কিন্তু সিনেমা তৈরির জন্য যত শ্রম ব্যয় করা হয় তা শ্রদ্ধেয় বলেই গণ্য। কারণ এটি একটি কাজ এবং এই কাজ আর্থিক মুনাফা আনে। বাঞ্ছনীয় কাজ তাকেই বলতে হবে যা মুনাফা ঘরে আনে, এই মনোভাবটাই সব কিছু উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। যে কসাই আপনাকে মাংস যোগান দেয় এবং যে রুটি প্রস্তুতকারক আপনার রুটি যোগায় তারা প্রশংসার যোগ্য। কারণ তারা অর্থ উপার্জন করছে; কিন্তু আপনি যখন তাদের যোগানো খাদ্য ভোগ করছেন, তখন আপনি নিতান্তই লঘুচেতা, যদি আপনি কাজ করার জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে আহার না করে থাকেন। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, মনে করা হয় যে অর্থ উপার্জন ভালো। আর অর্থ ব্যয় মন্দ। একে একই আদান-প্রদানের দুই দিক হিসেবে দেখা, একেবারেই অসংগত তাহলে একজন ধরে নিতে পারেন চাবি ভালো, তালার চাবি ঢুকানোর ছিদ্র মন্দ। পণ্য উৎপাদনে যে ধরনের গুণই থাক না কেন তা অবশ্যই নির্ভর করবে উক্ত পণ্য ভোগ থেকে কতটা সুবিধা লাভ করা গেল তার উপর। আমাদের সমাজে যে-কোনো ব্যক্তি মুনাফার জন্য কাজ করে; কিন্তু তার কাজের সামাজিক উদ্দেশ্য উৎপাদিত পণ্য উপভোগের মধ্যে নিহিত। উক্ত ব্যক্তি এবং উৎপাদনের সামাজিক লক্ষ্যের মধ্যে এই যে বিচ্ছেদ তা বর্তমান দুনিয়ায় মানুষকে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করা কঠিন করে দেয়। কারণ এই জগতে মুনাফা অর্জন কর্মের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। আমি উৎপাদনের কথা খুব বেশি ভাবি। ভোগের কথা ভাবি খুবই কম। এতে একটা ফল দাঁড়ায় আমরা উপভোগ ও সরল সুখের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদান করি, এবং উৎপাদনের বিচার আমার ভোক্তা কতটা আনন্দ পেল সে অনুসারে করি না।