দেশ-অনেক যুগে এবং স্থানে দেশপ্রেম ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাসের ব্যাপার। এই বিশ্বাসের প্রতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ সম্মতি দিতে পারতেন। শেক্সপিয়রের সময়ে ইংল্যাণ্ডে, ফিশতের সময়ে জার্মানিতে, ম্যাসিনির সময়ে ইতালিতে এই বিশ্বাসটা ছিল। পোল্যাণ্ড, চিন এবং বহির্মঙ্গোলিয়ায় এই বিশ্বাসটা এখনও বিদ্যমান। পশ্চিমের জাতিসমূহের মধ্যে দেশপ্রেম এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী। সেখানকার রাজনীতি, সরকারি ব্যয়, সামরিক প্রস্তুতি এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয় দেশপ্রেম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বুদ্ধিমান তরুণরা দেশপ্রেমকে পর্যাপ্ত আদর্শ হিসেবে গ্রহণে অপারগ; তারা মনে করে নিপীড়িত জাতির জন্য দেশপ্রেম খুবই দরকার, কিন্তু নিপীড়িত জাতি স্বাধীনতা অর্জন করার পরই যে জাতীয়তাবাদ এক সময় বীরত্বব্যঞ্জক ছিল তা নিপীড়নমূলক হয়ে পড়ে। পোল্যাণ্ডবাসীরা মারিয়া তেরেসা অশ্রু বিসর্জন দেবার পর থেকে আদর্শবাদীর সহানুভূতি ভোগ করেছেন, আবার তারাই নিজেদের স্বাধীনতা সংগঠিত করেছেন ইউক্রেনীয়দের নিষ্পেষণের জন্য। আইরিশ জনগণ, যাদের উপর ব্রিটিশ জাতি আট শ বছরের জন্য সভ্যতা আরোপ করেছিল, নিজেদের স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে আইন প্রণয়ন করে উৎকৃষ্টমানের বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। পোলরা ইউক্রেনীয়দের খুন করছে আর আইরিশরা খুন করছে সাহিত্য, এই দৃশ্যগুলো একটি ক্ষুদ্র জাতির জন্যও জাতীয়তাবাদ যে আদর্শ হিসেবে অপর্যাপ্ত তা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শক্তিধর জাতির বেলা যুক্তিটা বাড়তি শক্তি লাভ করে। ভার্সাই সন্ধি তাদের কাছে খুব একটা প্রেরণাদায়ক ব্যাপার ছিল না যাদের আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে ভাগ্যবলে আত্মাহুতি দিতে হয়নি। অথচ এই আদর্শগুলোর প্রতি তাদের শাসকরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। যুদ্ধ চলাকালে যারা এই নীতিবাক্য প্রচার করতেন যে তারা সমরবাদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান, যুদ্ধের শেষে তারাই নিজ-নিজ দেশে সমরবাদীতে পরিণত হন। এই ধরনের ঘটনা বুদ্ধিমান তরুণদের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে তুলেছে যে দেশপ্রেম বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এবং এই সমরবাদী নীতি যদি নমনীয় না করা যায় তাহলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রগতি-মার্জিত তরুণদের কাছে এই উনিশ শতকী আদর্শে খুব বেশি ব্যাবিট জাতীয় মানবতা রয়েছে। পরিমাপযোগ্য প্রগতি ঘটে মোটর গাড়ি তৈরির সংখ্যা কিংবা কী পরিমাণ বাদাম ভক্ষণ করা হলো, এই জাতীয় গুরুত্বহীন ব্যাপারে। প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু পরিমাপযোগ্য নয়। ফলে এটা মান উন্নয়ন কিংবা সংখ্যা বাড়ানোয় আগ্রহী ব্যক্তির পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত বিষয় নয়। উপরন্তু বহু আধুনিক উদ্ভাবন মানুষকে করেছে অসহায়। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে রেডিও, সিনেমা এবং বিষাক্ত গ্যাসের নামোল্লেখ করতে পারি। শেক্সপিয়র একটি যুগের উত্তৰ্ষ পরিমাপ করেছেন ঐ যুগের কাব্যশৈলী দ্বারা (৩২তম সনেট দেখুন)। কিন্তু পরিমাপের উক্ত রীতি এখন সেকেলে হয়ে গেছে।
সৌন্দর্য-সৌন্দর্য জিনিসটায় এমন কিছু আছে যার জন্য একে সেকেলে মনে হয়। কিন্তু কেন যে সেকেলে মনে হয় সেটা বলা দুষ্কর। যদি আধুনিক কোনো চিত্রকর সম্পর্কে অভিযোগ তুলে বলা হয় যে তিনি সৌন্দর্য-সন্ধানী তাহলে তিনি তো ক্ষেপেই যাবেন। আজকাল দেখা যায় অধিকাংশ শিল্পী জগতের বিরুদ্ধে ক্রোধ-দ্বারাই উদ্বুদ্ধ বোধ করেন, সুতরাং তারা নির্মল সন্তোষের চেয়ে তাৎপর্যময় ব্যথার চিত্র আঁকায় সমধিক উৎসাহী। তদুপরি অনেক ধরনের সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দেয়ার জন্য একজনকে কিছুটা ভাবগম্ভীর হতে হয়, যা বুদ্ধিমান আধুনিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এথেন্স কিংবা ফ্লোরেন্সের মতো ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের একজন ক্ষমতাবান নাগরিক অনায়াসে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে গণ্য করতে পারতেন। তখন ধুলার ধরণী ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত, সৃষ্টির লক্ষ্যই ছিল মানুষ, তার শহর মানুষকে সর্বোকৃষ্ট করে তুলেছে, তিনি নিজেও নিজ শহরের সর্বোকৃষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম। অনুরূপ পরিস্থিতিতে ঈস্কিলাস কিংবা দান্তে স্বীয় আনন্দ ও বেদনা গুরুত্ব দিয়ে নিতে পারতেন। তিনি অনুভব করতে পারতেন ব্যক্তি-আবেগের মূল্য রয়েছে, আরো অনুভব করতেন বিয়োগান্তক ঘটনা অমর কবিতায় ধরে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক মানুষ, যখন দুর্ভাগ্যপীড়িত হয়, নিজেকে পরিসাংখ্যিক সমগ্রতার পূর্ণসংখ্যা হিসেবে দেখতে পায় তাদের চোখের সামনে অতীত ও বর্তমান ভেসে ওঠে তুচ্ছ পরাজয়ের নিরানন্দ মিছিল হিসেবে। মানুষকেই তাদের মনে হয় হাস্যকর দাম্ভিক জীবন হিসেবে। এই মানুষ অসীম নিস্তব্ধতার ভেতর সংক্ষিপ্ত বিরতির সময় কেবলি চিৎকার আর হইচই করে। unaccomodated man is no more but such a poor, bare, forked animal.১৮ বলেন রাজা লিয়র এবং এই ধারণা তাকে উন্মাদ করে দেয়, কারণ এই ধারণাটি তার কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু এই ধারণা আধুনিক মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। ফলে উক্ত ধারণা মানুষ যে তুচ্ছ শুধু এই বিশ্বাসে তাদের পৌঁছায়।
সত্য-পুরাকালে সত্য ছিল সন্দেহাতীত, শাশ্বত এবং অতি-মানবিক। তরুণ বয়সে আমি নিজে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি এবং সত্য-সন্ধানে নিজেকে নিবেদন করে তারুণ্যের অপব্যয় করি। আজ কিন্তু একদল শত্রুর অভ্যুদয় ঘটেছে যারা সত্য নিধনে প্রস্তুত: প্রয়োগবাদ, ব্যবহারবাদ, মনস্তত্ত্ববাদ, আপেক্ষিকতা পদার্থশাস্ত্র এই শক্রদলের অন্যতম। গ্যালিলিও এবং ইনকুইজিশন এ ব্যাপারে এক হতে পারেনি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিক প্রদক্ষিণ করে নাকি সূর্যই পৃথিবীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে। তবে তারা একমত ছিলেন যে এ প্রসঙ্গে তাদের মতামতের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তবে যে একটি ব্যাপারে তারা অভিন্ন মত পোষণ করতেন তা ছিল একেবারে ভুল। মতটি হলো, এ ব্যাপারে তারা যা বলছেন তা শুধু শব্দগত প্রভেদের ব্যাপার। প্রাচীনকালে সত্যের পূজা সম্ভব ছিল; বাস্তবিক পক্ষে মানব বলি দেয়ার যে প্রথা ছিল তা থেকেই পূজার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ মেলে। কিন্তু সরল মানবিক এবং আপেক্ষিক সত্যের পূজা করা কঠিন বৈকি। এডিংটনের মতে মধ্যাকর্ষণ সূত্র পরিমাপের সুবিধাজনক নিয়ম মাত্র। এই সূত্র অন্যান্য সূত্রের চেয়ে অধিকতর সত্য নয়, যেমন পরিমাপের মেট্রিক পদ্ধতি ফুট ও গজ থেকে অধিক সত্য নয়।