রুশদেশের তরুণরা সিনিক নয়, কারণ তারা সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্ট দর্শন গ্রহণ করে, এবং দেশটি বিরাট ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, বুদ্ধি দ্বারা ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়ে আছে। সুতরাং তরুণরা অনুভব করে তাদের জন্য অর্থপূর্ণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ। ইউটোপিয়া সৃষ্টি করতে গিয়ে আপনি যখন পাইপলাইন বসাচ্ছেন, গড়ছেন রেলপথ কিংবা কৃষককে শিক্ষা দিচ্ছেন একযোগে চার মাইল ক্ষেত্রে ফোর্ডের ট্রাক্টর চালনা তখন আপনাকে জীবনের লক্ষ্যে নিয়ে ভাববার দরকার করবে না। ফলে রুশ যুবকরা সতেজ এবং আন্তরিক বিশ্বাসে আপ্লুত।
ভারতের অকপট যুবকদের মৌলিক বিশ্বাস এই যে, ইংরেজরা দুষ্ট প্রকৃতির এই উদাহরণ থেকে, যেমন দেকার্তরে অস্তিত্ব বিষয়ক দর্শন থেকে, একটা সমগ্র দর্শন দাঁড় করা যায়। ইংরেজরা যেহেতু খ্রিষ্টান, এই তথ্য থেকে ধরে নেয়া হয় যে হিন্দুধর্ম কিংবা ইসলামধর্ম (যখন যেমন) একমাত্র সত্য ধর্ম। ইংল্যান্ড যেহেতু পুঁজিবাদী এবং শিল্পপ্রধান, অতএব সংশ্লিষ্ট তার্কিকের মেজাজ অনুসারে প্রত্যেকে চকরা ঘুরাবে কিংবা দেশীয় শিল্প ও পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য সংরক্ষণমূলক কর আরোপ করতে হবে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিবাদে এসবই হবে প্রধান হাতিয়ার। আর যেহেতু ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখলে রেখেছে সামরিক শক্তির জোরে, অতএব নৈতিক বল একমাত্র শ্রদ্ধেয় ব্যাপার। তাছাড়া ভারতের জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড নিগ্রহ তাদেরকে বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাদের অসার বা তুচ্ছ মনে করার জন্য যথেষ্ট নয়। এইভাবে ঈঙ্গ-ভারতীয়রা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত যুবকদের সিনিসিজমের অনিষ্টকর প্রভাব থেকে রক্ষা করেন।
চিন দেশে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণাও একটা ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এই ঘৃণার পরিমাণ ভারতের চেয়ে কম, কারণ ইংরেজরা ঐ দেশ কোনো দিন জয় করেনি। চৈনিক যুবকরা দেশপ্রেমের সঙ্গে প্রতীচ্যবাদের প্রতি আন্তরিক আগ্রহ যুক্ত করেন। পঞ্চাশ বছর আগে জাপান এই কাজটিই করেছিল। চৈনিক যুবকরা চান চিনের জনগণ আলোকপ্রাপ্ত হোন, স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী হোন এবং এর ফল লাভের জন্য তাদের কাজকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে তাদের এই আদর্শ উনিশ শতকের, কিন্তু চিনের জন্য এটা বিগত (প্রাচীন) কালের হয়ে যায়নি। চিনে সিনিসিজম জড়িত ছিল রাজকীয় শাসনযন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে, যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের মধ্যে এ মনোভাবটা ছিল, যারা ১৯১১ সাল থেকে দেশটিকে বিপথগামী করে। কিন্তু আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতায় সিনিসিজমের স্থান নেই। জাপানের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত ইউরোপীয় কন্টিনেন্টের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন নয়। উদারতন্ত্রের নীতিবাক্য এখনও প্রবল: সংসদীয় সরকার, প্রজার স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা এই সব নিয়ে তোলপাড় চলে। ঐতিহাসিক সামন্তপ্রথা এবং স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তরুণদের ব্যস্ত ও উদ্দীপনার ভেতর রাখার জন্য যথেষ্ট।
পশ্চিমের স্বাভাবিক সারল্যচ্যুত যুবকদের কাছে উষ্ণ আবেগ জিনিসটা গ্রাম্য ব্যাপার বলে অনুভূত হয়। তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে সবকিছু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে তারা সব কিছু দেখতে পেরেছে এবং লক্ষ্য করেছে যে ভ্রাম্যমাণ চাঁদের নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অবশ্য পুরাকালীন শিক্ষায় এর পক্ষে বিপুল যুক্তি রয়েছে। আমি মনে করি না যে, এই যুক্তিগুলো সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে পারে। কারণ অন্যান্য পরিস্থিতিতে যুবকরা পুরাকালীন শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং নিজেরাই আলাদা সুসমাচার (Gospel) তৈরি করে নেয়। আজকের প্রতীচীর তরুণরা যদি শুধু সিনিসিজম দ্বারা প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে সেই পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই বিশেষ কারণ থাকবে। তরুণরা শুধু তাদেরকে যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করতে অসমর্থ নয়। তারা সব কিছু বিশ্বাস করতে অসমর্থ। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর কারণ খোঁজার জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা প্রথমে কতকগুলো পুরাতন আদর্শ একটা একটা করে আলোচনা করে দেখি তারা কেন পুরাতন আনুগত্যসমূহে প্রেরণা পায় না। ধর্ম, দেশ, প্রগতি, সৌন্দর্য, সত্য, আদর্শ হিসেবে এইগুলোর নাম আমরা করতে পারি। তরুণদের চোখে এগুলোর মধ্যে ভ্রান্তি কোথায়?
ধর্ম-এখানে অসুবিধাটা অংশত পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত, অংশত সামাজিক। পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত কারণে খুব কম শিক্ষিত লোকেরই এখন ধর্মীয় বিশ্বাসে তীব্রতা আছে, যা সম্ভব ছিল, ধরুন, সেন্ট টমাস অ্যাকুনাসের সময়। অধিকাংশ আধুনিক মানুষের কাছে ঈশ্বর কিছুটা অস্পষ্ট, জীবন শক্তির নামান্তর কিংবা এমন কোনো শক্তি নয় যা আমাদের জন্য ন্যায়ের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও পরজগতের চেয়ে ধর্মের ইহজাগতিক ফলাফল নিয়ে অধিক ভাবেন। তারা খুব একটা নিশ্চিত নন যে এই জগত ঈশ্বরের গৌরব প্রকাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। তারা বরং ঈশ্বরকে ব্যবহারিক প্রকল্প মনে করেন যার কাজ হলো বর্তমান জগতের উন্নতিসাধন। ঈশ্বরকে পার্থিব জগতের প্রয়োজনের অধীনস্ত করা তারা প্রকারান্তরে নিজেদের বিশ্বাসের আন্তরিকতায় সংশয় লেপন করেন। তারা হয়তো ভাবেন, সাবাথেরমতো ঈশ্বরকেও মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছিল। গির্জাসমূহকে আধুনিক আদর্শের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করার সমাজতাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। গির্জাগুলো উপহার হিসেবে প্রাপ্ত প্রভূত সম্পত্তির জন্য ঐ সম্পত্তি রক্ষার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। উপরন্তু এসব গির্জা নিষ্পেষণমূলক নীতির সঙ্গে জড়িত, এই নীতমালা জীবনের অনেক সুখকে নিন্দনীয় বলে রায় দিয়ে বসে আছে, আর তরুণরা এসব সুখের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু দেখতে পান না। গির্জাগুলো নানা প্রকার অত্যাচারও করে থাকে। আর সন্দেহবাদীদের কাছে তা অপ্রয়োজনীয়ভাবে নির্দয় বলে মনে হয়। আমি বেশ কিছু উৎসুক তরুণকে জানি যারা খ্রিষ্টের শিক্ষাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন পরে তারা দেখতে পান যে তাদের গির্জাচালিত খ্রিষ্টধর্মের বিরোধী এবং সমাজচ্যুত গণ্য করা হয়। তাদের অত্যাচারও সইতে হয়েছে, যেন তারা যুধ্যমান নাস্তিক্যবাদী।