প্রতীচ্য সভ্যতার পরিবর্তন হয়েছে এবং এতটা দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে যে যারা এই সভ্যতার অতীতের প্রতি অনুরাগ বোধ করেন তারা দেখতে পান নিজেরা যেন ভিন্ন জগতে বাস করছেন। তবে চলতি কালটা এমন উপাদান আরো সুস্পষ্টভাবে বের করে আনছে যা রোমকদের সময় থেকে কিছু পরিমাণে সব সময় বিরাজিত ছিল, এবং এটাই সব সময়ই ভারত ও চীন থেকে ইউরোপকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। বীর্য, সহিষ্ণুতা এবং বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তি ইউরোপের স্বর্ণযুগকে প্রাচ্যের স্বর্ণ যুগ থেকে বিশিষ্টতা দেয়। সাহিত্য ও শিল্পে গ্রিকদের হয়তো শ্ৰেষ্ঠতা ছিল, তবে চিনের তুলনায় তাদের শ্রেষ্ঠতা মাত্রার ব্যাপারে শুধু। শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমি অনেক কিছু বলছি; কিন্তু অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, কারণ ইউরোপের এই বৈশিষ্ট্য জনগণ যতটা উপলব্ধি করেন তার চেয়েও প্রকট।
গ্রিকদের এই অসদগুণের প্রতি আসক্তি তার উত্তরসূরিদের চেয়ে অনেক কম ছিল। তবু তারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে; এবং প্লেতো, সক্রেটিসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও, মনে করতেন রাষ্ট্র একটা ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, এবং ঐ ধর্ম সম্পর্কে যদি কেউ সন্দেহ পোষণ করে তবে তাকে নির্যাতন করতে হবে। অবশ্য তিনি নিজে ঐ ধর্মকে মিথ্যা জ্ঞান করতেন। কনফুশিয়াস, তাও এবং বুদ্ধপন্থীরা এধরনের হিটলারসুলভ মতবাদ মেনে নিতেন না। প্লেতোর ভদ্রলোকোচিত শালীনতা ঠিক ইউরোপীয় ছিল না; ইউরোপ শাহুরিক ও মার্জিত নয়, বরং সমরপ্রিয় ও চতুর ছিল। প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতা বরং খুঁজে পাওয়া যাবে পুটার্কের সিরাকুস প্রতিরক্ষার বিবরণে। উক্ত যুদ্ধে সিরাকুস আর্কিমিডিস উদ্ভাবিত যান্ত্রিক কৌশলাদি কাজে লাগায়।
নির্যাতনের একটি উৎস, যেমন গণতান্ত্রিক ঈর্ষা, গ্রিকদের মধ্যে খুবই বিকাশ লাভ করে। আরিস্টিডেসকে নির্বাসিত করা হয় কারণ তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রসিদ্ধি উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল; ইফিসাসের হিরাক্লিটাস উল্লসিত হয়ে বলেছেন: ইফিসাসবাসীদের উচিত নিজেদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, অন্তত এর প্রতিটি বয়স্ক ব্যক্তির তাই করা উচিত এবং নগরটা দাড়িহীন বালকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক; কারণ তারা তাদের মধ্যেকার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হারমোডোরাসকে বহিষ্কার করেছে এই বলে আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাউকে থাকতে দেয়া হবে না; যদি কেউ থাকে সে অন্যত্র চলে যাবে, অন্যদের মাঝে বাস করবে। আমাদের কালের অপ্রিয় অনেক বৈশিষ্ট্যই গ্রিকদের ছিল। তাদের মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমরবাদ, ক্যুনিজম, অফিসের প্রভু এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ; তাদের মধ্যে কলহপ্রিয় কদর্যতা এবং ধর্মীয় নির্যাতনও দেখা গেছে। তাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তি ছিল, তা আমাদের মধ্যেও তো রয়েছে; এখনকার মতো তখনও উৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাসন, কারাবাস এবং মৃত্যুবরণ করেছে। গ্রিক সভ্যতার অবশ্য একটা ব্যাপারে আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠতা ছিল, সেটা হলো পুলিশের অদক্ষতার ক্ষেত্রে। ফলে তখন মার্জিত লোকদের বিরাট একটা অংশ পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে।
কন্সটানটাইন কর্তৃক খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পরই শুধু নিপীড়নকারী আবেগ সম্পূর্ণ প্রকাশের প্রথম সুযোগ পায়, এই নিপীড়নকারী আবেগের জন্যই ইউরোপ এশিয়া থেকে বিশিষ্ট। সত্য যে, গত দেড়শো বছরের বিরতিকালে উদারতন্ত্র ছিল, কিন্তু এখন আবার শ্বেত জাতিসমূহ ধর্মতাত্ত্বিক গোঁড়ামিতে ফিরে যাচ্ছে। এই গোঁড়ামি খ্রিষ্টানরা পেয়েছিল ইহুদিদের কাছ থেকে। ইহুদিরাই প্রথম এই ধারণা উদ্ভাবন করে যে কেবল একটা ধর্মই সত্য হতে পারে। কিন্তু তারা চায়নি যে সারা জগৎ এই ধর্ম গ্রহণ করুক। সুতরাং তারা কেবল অন্যান্য ইহুদিদের অত্যাচার করেছে। খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ঈশ্বরের বিশেষ প্রত্যাদেশে বিশ্বাস সংরক্ষণ করেও এতে যোগ করেছেন রোমকদের জগব্যাপী আধিপত্যের বাসনা এবং গ্রিকদের আধিবিদ্যক সূক্ষ্মতা। এই সমন্বয় সৃষ্টি করেছে অত্যন্ত হিংস্রভাবে নির্যাতনকারী একটি ধর্ম এবং ধর্মের ক্ষেত্রে এতটা হিংস্রতা ইতোপূর্বে ছিল না। জাপান ও চিনে বৌদ্ধধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হয় এবং শিন্টো ও কনফুশীয় ধর্মের পাশাপাশি অবস্থানের অনুমোদন দেয়: মোহামেডান জগতে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের অত্যাচার করা হয়নি যতদিন তারা নজরানা প্রদান করেছে; কিন্তু খ্রিষ্টীয় জগতে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে ক্ষীণ বিচ্যুতিরও স্বাভাবিক শান্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
যারা ফ্যাসিবাদ ও ক্যুনিজমের অসহিষ্ণুতা পছন্দ করেন না তাদের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই, অবশ্য যদি না তারা মনে করেন এটা ইউরোপীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি। নিপীড়নমূলক সরকারি গোঁড়ামির আবহে আমাদের মধ্যে যারা মনে করেন তাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে তারা আধুনিক রাশিয়া কিংবা জার্মানির চেয়ে ইউরোপের অতীতের যুগগুলোতে খুব ভালো বোধ করতেন না। জাদুর সাহায্যে আমরা যদি অতীতে ফিরে যেতে পারি, আমরা কি দেখবো আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের চেয়ে স্পার্টা উন্নততর? আমরা কি সেই সমাজগুলোতে বাস করতে পছন্দ করতাম যোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের মতো সে সমাজ ডাইনিতে অবিশ্বাস করলে মৃত্যদণ্ড প্রদান করেছে? আমাদের কি সহ্য হতো গোড়ার দিকের নিউ ইংল্যাণ্ড, কিংবা ইনকাদের প্রতি পিযারোর (Pizarro) আচরণ? রেনেসাঁস জার্মানি কি উপভোগ্য লাগত, যেখানে ১,০০,০০০ ডাইনিকে পুড়িয়ে মারা হয়? আমাদের কি ভালো লাগত অষ্টাদশ শতকের আমেরিকা, যেখানে বোস্টনের প্রধান। যাজকগণ ম্যাসাচুসেটসের অগ্নিগিরির জন্য দায়ী করেন বিদ্যুত্বহী তারের অধার্মিকতাকে? উনিশ শতকে আমরা কি নবম পোপ পাইয়াসকে সমর্থন করতাম যিনি জন্তু-জানোয়ারের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ সমাজকে নাকচ করে দেন এই যুক্তিতে যে নিম্ন শ্রেণির জীবের প্রতি মানুষের কোনো কর্তব্য আছে এই বিশ্বাস ধর্মবিরোধী? আমি আশংকিত যে ইউরোপ যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, এই মহাদেশ সর্বকালেই বীভৎস। ছিল, কেবল ১৮৪৮ থেকে ১৯১৪, এই সংক্ষিপ্ত সময়টা বাদ দিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত এখন। আবার আদিরূপে প্রত্যাবর্তন করছে।
০৯. তারুণ্যপূর্ণ সিনিসিজম
পশ্চিম দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটু ঘোরাফেরা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, আজকের বুদ্ধিমান তরুণেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সিনিক। রাশিয়া, ভারত, চিন কিংবা জাপানের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। আমি বিশ্বাস করি চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া এবং পোল্যান্ডেও এমনটা দেখা যাবে না, এবং কোনোক্রমেই জার্মানিতে এটা সার্বজনীন ব্যাপার হতে পারে না। কিন্তু এটা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিমান তরুণদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমের তরুণেরা কেন সিনিক তা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে প্রাচ্যের তরুণরা কেন সিনিক নয়।