একটা কৌতূহলজাগর ব্যাপারে কল্পনা খাটানো যায়; তাহলো, ব্যক্তি নয়, সমষ্টির প্রচেষ্টায় উন্নতমানের কিছু সৃষ্টি করা যায় কি-না এবং তেমন ধরনের সভ্যতা সর্বোৎকৃষ্ট মানের হতে পারে কি-না। আমি তো মনে করি এই প্রশ্নের উত্তর হঠাৎ করে দেয়া সম্ভব নয়। এটা সম্ভব যে শিল্পকলা এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয় ব্যাপারে অতীতে ব্যক্তির প্রচেষ্টায় যা অর্জন করা যেত এখন সহযোগিতার মাধ্যমে তার চেয়ে উন্নততর কিছু অর্জন করা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে, কোনো কাজের ব্যাপারে ব্যক্তি নয়, গবেষণাগার-সংশ্লিষ্টতা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা আরো সুস্পষ্টভাবে হলে তা বিজ্ঞানের জন্য হয়তো ভালোই হবে, কারণ এতে সহযোগিতা বাড়বে। কিন্তু যে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি সামষ্টিকভাবে করতে হয় তাহলে প্রয়োজনেই ব্যক্তিকে খাটো করতে হবে: সে-ক্ষেত্রে তারা এতকাল যে প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে বড়াই করে এসেছেন সেটা আর সম্ভব হবে না। এই সমস্যায় প্রবেশ করে খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, তবে স্বাভাবিকভাবে যা মনে করা হয় তার বিপরীত অর্থে। সাধারণভাবে ভাবা হয় যে, যেহেতু খ্রিস্টধর্ম পরার্থবাদী এবং প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে বলে, অতএব এই ধর্ম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বিরোধী। যাহোক এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রমাদ। খ্রিস্টধর্মের আবেদন ব্যক্তির আত্মার প্রতি এবং এই ধর্ম ব্যক্তির মোক্ষের উপর জোর দেয়। একজন মানুষ তার প্রতিবেশীর জন্য যা করে, সে তা করে কাজটি তার জন্য সঠিক বলে, কারণ এই নয় যে সে, স্বাভাবিকভাবে কোনো বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ বলে তা করে। সূচনা থেকেই খ্রিস্টধর্ম, এবং এখনও আবশ্যিকভাবে, রাজনৈতিক নয়, এমনকি পারিবারিকও নয়। ফলে এর ঝোঁক হলো প্রকৃতি ব্যক্তিকে যতটা বানিয়েছে তার চেয়ে বেশি স্বয়ম্ভর করে তোলা। অতীতে পরিবার ব্যক্তি-সংশোধনের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন পরিবারের অবক্ষয় ঘটছে এবং মানুষের প্রবণতার উপর যে অধিকার ছিল তা হারিয়ে ফেলেছে। পরিবার যা হারিয়েছে, জাতির তাই লাভ হয়েছে। কারণ জাতি আবেদন রাখে মানুষের নৈতিক প্রবৃত্তির উপর, যে প্রবৃত্তিগুলো শিল্পায়িত জগতে কোনো সুযোগ পায় না। একজনের ইচ্ছে হয় মানুষ যদি তার জৈবিক সহজাত আবেগসমূহকে মানববংশের কল্যাণে প্রয়োগ করত; কিন্তু এটা মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়। বাহ্যিক কোনো বিপদ, যেমন নতুন কোন রোগ কিংবা সার্বিক দুর্ভিক্ষ, হুমকি হয়ে দাঁড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। এগুলো যেহেতু সম্ভব নয় তাই আমি দেখতে পাই না এমন কোনো মনস্তাত্ত্বিক উপায়ের সম্ভাবনা যা দিয়ে বিশ্ব-সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটা উপায় তবু থেকে যায় কোনো জাতি বা কয়েকটা জাতি মিলে যদি গোটা বিশ্ব জয় করে। মনে হয় বিকাশের এটাই স্বাভাবিক ধারা, হয়তো আগামী এক শো কি দুশো বছরের মধ্যে এটা সম্ভবও হবে। পশ্চিমের সভ্যতার বর্তমান অবস্থায় প্রথাগত সকল উপাদানের চেয়ে বিজ্ঞান ও শিল্পপ্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। এ থেকে মনে করা ঠিক হবে না যে মানবজীবনের উপর এইসব নতুনত্বের ফলাফল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে: অতীত যুগের চেয়ে এখন সব কিছু দ্রুততর গতিতে চলে, তাই বলে খুব বেশি দ্রুত গতিতে চলে না। মানবিকতা বিকাশে গুরুত্বের দিক থেকে শিল্পযুগের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে এমন সর্বশেষ ঘটনা হলো কৃষিবিজ্ঞান উদ্ভাবন এবং পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে এর সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। সঙ্গে-সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে ভাবনা-ধারণার একটি রীতি ও জীবন যাপনের পদ্ধতি। এমনকি কৃষিজীবন পদ্ধতি এখনও পৃথিবীর সকল অভিজাততন্ত্রকে জয় করতে পারেনি এবং অদ্ভুত রক্ষণশীলতার সঙ্গে এখনও শিকার যুগের স্তরে রয়ে গেছে, শিকারের জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণের নিয়মাবলি থেকে আমরা তা বুঝতে পারি। অনুরূপভাবে আমরা আশা করতে পারি যে কৃষিকার্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনুন্নত দেশসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর অনুন্নত অংশে বহুকাল টিকে থাকবে।
তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা সভ্যতার বিশিষ্টতা নয়, কিংবা এর থেকে প্রাচ্যে যা জন্ম নিচ্ছে তাও নয়। আমেরিকায় দেখতে পাওয়া যায়, এখানকার কৃষিকার্যও আধা-শৈল্পিক মানসিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারণ আমেরিকায় কোনো দেশীয় কৃষককুল নেই। রাশিয়া এবং চিনে সরকারের শিল্পায়নের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কিন্তু বিরাট অজ্ঞ কৃষি জনসংখ্যার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে হয়। যাহোক, এই সঙ্গে এটা স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, যে জনগোষ্ঠী লিখতে পড়তে জানে না তাদের সরকারি প্রচেষ্টায় দ্রুত পরিবর্তন করা যায়; পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপারটা ভিন্ন বলে কাজটা কঠিন। অক্ষরজ্ঞান বাড়িয়ে এবং সঠিক প্রচার প্রয়োগ করে রাষ্ট্র উদীয়মান প্রজন্মকে প্রবীণদের এতটা ঘৃণা করতে শেখাতে পারে যে, এতে সর্বোন্নত বিষয়াসক্ত আমেরিকাবাসীও অবাক মানবে, এবং এভাবে এক প্রজন্মের মধ্যে মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিবর্তন সাধন সম্ভব। রুশদেশে এই প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে; চিনে শুরু হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায় যে এই দুটি দেশ শিল্পের অনুকূলে নির্ভেজাল মানসিকতা গড়ে তুলবে। এই মানসিকতা হবে সেই সব প্রথাগত উপাদান থেকে মুক্ত, যা অতি ধীরে বিকাশমান পশ্চিমে এখনও টিকে আছে।