আধুনিক জগতে সামাজিক সংহতির উচ্চ মাত্রার জন্য প্রধানত দায়ী যুদ্ধকৌশলের পরিবর্তন; এবং গোলাবারুদ থেকে শুরু করে সবকিছুর উদ্ভাবন সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সম্ভবত এই প্রক্রিয়া কোনো মতেই শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু এটা একটা নতুন উপাদানকে জটিল করে তুলেছে: যেহেতু সেনাবাহিনী অস্ত্রাদির জন্য শিল্প শ্রমিকদের উপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাই সরকারের খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের সমর্থনের। এই ব্যাপারটা প্রচারণা কৌশলের কাজ এবং এক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে সরকারগুলো দ্রুত উন্নতি সাধন করবে বলেই মনে হয়। গত চার শ বছরের ইউরোপের ইতিহাস ছিল একই সঙ্গে উন্নতি ও অবক্ষয়ের, পুরাতন সংশ্লেষণের অবক্ষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে ক্যাথলিক গির্জা, এবং এখনও সম্পূর্ণ না হলেও, নতুন সংশ্লেষণের উন্নতি অদ্যাবধি দেশপ্রেম এবং বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল থেকেছে। এটা মনে করা যায় না যে আমাদের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা অন্যত্র প্রতিস্থাপন করলে একই ফল পাওয়া যাবে বা উক্ত স্থানের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা আমাদের অনুরূপ হবে। খ্রিষ্টধর্ম এবং গণতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞান এমন ফলাফল জন্ম দিতে পারে যা কুলপূজা এবং একচ্ছত্র রাজতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞানের ফলাফল থেকে একেবারে আলাদা। ব্যক্তির প্রতি সুনির্ধারিত শ্রদ্ধার জন্য আমরা খ্রিষ্টধর্মের কাছে ঋণী, কিন্তু এই অনুভূতির প্রতি বিজ্ঞান সম্পূর্ণত নিরপেক্ষ। বিজ্ঞান নিজের থেকে কোনো নৈতিক আদর্শের প্রস্তাব করে না, এবং এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে, কোন নৈতিক আদর্শ আমাদের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া নৈতিক আদর্শের স্থান দখল করবে। ঐতিহ্য খুব ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের নৈতিক আদর্শ যে পর্যায়ে এখনও রয়ে গেছে তা কেবল প্রাক-শিল্পযুগের উপযোগী; তাই বলে এই ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে বলে আশা করা যায় না। মানুষ ক্রমান্বয়ে এমন ভাবনা অধিকার করবে যা তার বাস্তব অভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এমন আদর্শ গ্রহণ করবে যা তার শিল্পপ্রযুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। জীবনোপায়ের পরিবর্তনের হার আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুততর; গত দেড় শ বছরে জগৎ যতটা পরিবর্তিত হয়েছে পূর্ববর্তী চার হাজার বছরে ততটা হয়নি। পিটার দ্য গ্রেট হামুরাবির সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে না-পারলেও একে অপরের কথা খুব ভালোভাবে বুঝতেন; কিন্তু এদের কেউ আধুনিক মহাজন কিংবা শিল্পপতির কথা বুঝতে পারতেন না। একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে, আধুনিক সময়ের সকল নতুন ধারণা কারিগরি কিংবা বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান অতি সম্প্রতি নতুন নৈতিক আদর্শ লালন শুরু করেছে, আর এটা শুরু করেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নৈতিক বিশ্বাসের আগল থেকে হিতৈষণা মুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রথাগত নীতি দুর্ভোগের দণ্ডের বিধান দেয় (উদাহরণত জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধকরণে), সেখানে একটু সদয় নীতিকে নৈতিকতাবিবর্জিত মনে করা হয়; ফলে যারা তাদের নীতিকে জ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হতে দেয়, তাদের অজ্ঞানতার অবতাররা দুষ্ট চরিত্রের গণ্য করে। যাহোক, অবশ্য এটা নিতান্তই সন্দেহজনক যে, আমাদের সভ্যতার মতো একটি সভ্যতা যখন এতটা বিজ্ঞাননির্ভর, তা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে, সফলতার সঙ্গে এমন জ্ঞান নিষিদ্ধ করতে পারবে যা মানুষের সুখ বিরাটাকারে বৃদ্ধি করতে সমর্থ।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে আমাদের প্রথাগত নৈতিক আদর্শ হয় ব্যক্তিগত পবিত্রতার ধারণার মতো একেবারে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক কিংবা আধুনিক জগতের গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উপযোগী। সামাজিক জীবনের উপর আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম প্রতিক্রিয়া হলো মানুষের কর্মকাণ্ড বিরাট মাত্রায় সংগঠিত হয়েছে বৃহত্তর গোষ্ঠী গঠনে, ফলে একজন মানুষের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া অনেক সময় এমন জনগোষ্ঠীর উপর পড়ে যে গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিজ গোষ্ঠীর সম্পর্ক সহযোগিতার কিংবা দ্বন্দ্বের। পরিবারের মতো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এবং এখন কেবলমাত্র একটাই বৃহৎ গোষ্ঠী টিকে আছে, জাতি কিংবা রাষ্ট্র, যে সম্পর্কে প্রথাগত নৈতিকতা কিছুটা পাত্তা দেয়। ফলে এই যে আমাদের কালের কার্যকরী ধর্ম, যদি শুধু প্রথাগত না হয়, দেশপ্রেম নিয়ে গঠিত। গড় মানুষ দেশপ্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক, এবং সে এই নৈতিক দায়িত্বকে এতটা বাধ্যতামূলক মনে করে যে তার কাছে কোনো বিদ্রোহ সম্ভবপর মনে হয় না।
এটা অসম্ভব মনে হয় না যে ব্যক্তি স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন যা ছিল রেনেসাঁসের যুগ থেকে উনিশ শতকী উদারতন্ত্রের যুগ পর্যন্ত সময়ের বৈশিষ্ট্য, তা শিল্পায়নের জন্য যে সংগঠনপ্রিয়তা বাড়ে তাতে বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যক্তির উপর সমাজের চাপ, নতুন আকারে এতটা বড় হতে পারে যার তুলনা মিলবে কেবল বর্বর গোষ্ঠীগুলোতে, জাতিসমূহও হয়তো ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির কৃতিত্বের চেয়ে সমষ্টির কৃতিত্ব নিয়ে নিজেরা বেশি গর্ব করবে। এই ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে লোকেরা গর্ববোধ করে গগণচুম্বী অট্টালিকা, রেলস্টেশন, সেতু ইত্যাদি নিয়ে; কবি, শিল্পী এবং বিজ্ঞানী নিয়ে তাদের কোনো গর্ব নেই। এই একই মনোভাব সোভিয়েত সরকারের দর্শনে অনুপ্রবেশ করেছে। সত্য যে, উভয় দেশে ব্যক্তিবীরের জন্য আকাক্ষা কাজ করে; রুশ দেশে ব্যক্তিগত বিশিষ্টতা কেবল লেনিনের; আমেরিকায় ক্রীড়াবিদ, মুষ্টিযোদ্ধা এবং চলচ্চিত্র তারকাদের। তবে উভয় ক্ষেত্রে কথিত বীরেরা হয় মৃত কিংবা তুচ্ছ এবং বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সেই কারণে প্রসিদ্ধ কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় না।