যাহোক, গ্রিকরা কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিলেন অযোগ্য এবং সভ্যতায় তাদের অবদান হয়তো সত্যিই হারিয়ে যেত শুধু রোমানদের প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য টিকে থাকে। রোমানরা আবিষ্কার করেন সিভিল সার্ভিস এবং আইন দ্বারা একটা বিরাট সাম্রাজ্যের প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তার কৌশল। পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে সবকিছু নির্ভর করেছে সম্রাটের শক্তিমত্তার উপর, কিন্তু রোমক সাম্রাজ্যে সম্রাট খুন হতে পারতেন প্রেটরীয়ান রক্ষীদের হাতে এবং সেনাবাহিনী প্রশাসন যন্ত্রের বিন্দব্রিাত্র ক্ষতি না করে সাম্রাজ্যের জন্য নিলাম ডাকতে পারতেন। আর প্রশাসন-যন্ত্রকে যতটা ঝুট ঝামলো পোহাতে হতো তার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে আজকের দিনে নির্বাচন পরিচালনায় যতটা ঝুটঝামেলা পোহাতে হয় তার সঙ্গে। মনে হয় রোমানরা ব্যক্তি প্রশাসকের প্রতি আনুগত্যের স্থানে নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রের প্রতি নিবেদিত চিত্ততার গুণ উদ্ভাবন করেন। সত্য যে, গ্রিকরা দেশপ্রেমের কথা বলতেন, কিন্তু তাদের রাজনীতিবিদরা ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ এবং এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময়ে পারস্য সম্রাটের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তির রোমক ধারণা পশ্চিমে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
প্রাক-আধুনিককালে প্রতীচ্য সভ্যতার জন্য আরো একটা উপাদানের আবশ্যকতা ছিল, আর তা হলো রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ক যা খ্রিষ্টধর্মের মাধ্যমে আসে। খ্রিষ্টধর্ম মূলত ছিল সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক। কারণ রোমক সাম্রাজ্যে এই ধর্মের বিকাশ ঘটে তাদের প্রতি সান্ত্বনা স্বরূপ যারা জাতীয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়েছিল; এবং এটা ইহুদি ধর্ম থেকে জগতের শাসককুলের প্রতি নৈতিক দোষারোপের মনোভাবটা গ্রহণ করে। কনস্ট্যাটাইনের আগে খ্রিস্টধর্ম এমন সংঘ গড়ে তোলে যার প্রতি খ্রিস্টানদের আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ছিল বেশি। রোমের পতনের পর ইহুদি, গ্রিক ও রোমক সভ্যতার সারাৎসার গির্জা অসাধারণ সংশ্লেষণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে। ইহুদি নীতিপরায়ণতা থেকে আসে খ্রিস্টধর্মের নীতিসূত্র; অবরোহী যুক্তির প্রতি গ্রিক অনুরাগ থেকে আসে ধর্মতত্ত্ব; রোমক সাম্রাজ্যবাদ এবং আইনবিজ্ঞানের উদাহরণ থেকে আসে গির্জার কেন্দ্রীভূত প্রশাসন এবং ক্যানন ল।
যদিও উচ্চ সভ্যতার এই উপাদানগুলো, এক অর্থে, গোটা মধ্যযুগে সংরক্ষণ করা হয়, তবু এসব দীর্ঘকাল কম-বেশি সুপ্তাবস্থায় থাকে। বস্তুত ঐ সময় পশ্চিমী সভ্যতা সর্বোকৃষ্ট ছিল না; মুসলমান এবং চৈনিক সভ্যতা ছিল উচ্চতর। কেন পশ্চিম দ্রুত উপরের দিকে উঠতে শুরু করল তা, আমি মনে করি, অনেকাংশে বিরাট রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। আজকের দিনের ঝোঁক হলো সবকিছুর অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান, কিন্তু এই অভ্যাসভিত্তিক ব্যাখ্যা ঘটনার অতিসরলীকরণ মাত্র। কেবল অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে, উদাহরণত, স্পেনের অবক্ষয় ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে অসহিষ্ণুতা এবং নির্বুদ্ধিতার ভেতর। বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ও অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। সাধারণ নিয়মে সভ্যতার অবক্ষয় ঘটে কেবল বৈদেশিক উন্নততর সভ্যতার সম্পর্কে এলে। মানব ইতিহাসের গুটিকয় বিরল যুগেই, এবং বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি ঘটে; এবং পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর সময় থেকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি লক্ষ্য করি। আমি মনে করি না যে কথিত যুগের এবং স্থানের সাধারণ সামাজিক অবস্থায় এমন কিছু ছিল যা, যে যুগে এবং স্থানে প্রগতি সংঘটিত হয়নি, তার থেকে বিশিষ্ট ছিল। তাহলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই হয় যে বিরাট প্রগতির যুগগুলো নির্ভর করেছে অসাধারণ দক্ষতা সম্পন্ন গুটিকয় ব্যক্তির উপর। অবশ্য এসবের কার্যকারিতার জন্য বিচিত্র সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার দরকার ছিল, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ দেখা গেছে অবস্থা অনুকূলে কিন্তু অসাধারণ ব্যক্তি নেই, অনুরূপ ক্ষেত্রে কোনো প্রগতির দেখা মেলেনি। যদি কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটন শৈশবেই দেহরক্ষা করতেন তাহলে আমরা এখন যে জগতে বাস করছি তার সঙ্গে ঘোড়শ শতাব্দীর যে বিরাট প্রভেদ, তা অনেক কম হতো। তাহলে এটা আমরা নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি যে প্রগতি কোনো নিশ্চিত ব্যাপার নয়; যদি বিখ্যাত ব্যক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা বাইজান্টাইন ধরনের স্থবিরতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবো।
মধ্যযুগের কাছে আমরা একটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঋণী, আর তা হলো প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এই পদ্ধতি প্রথম বারের মতো সম্ভব করে তুলেছে যে বৃহৎ সাম্রাজ্যের সরকারকে শাসিতের কাছে মনে হতে হবে ঐ সরকার তারাই নির্বাচন করেছে। এই পদ্ধতি যেখানে সফল হয় সেখানে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব হয় উচ্চমাত্রায়। তবে সম্প্রতিকালে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ধুলার ধরণীর সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য ঔষধি নয়। বাস্তবিকপক্ষে, মনে হয়, এর সাফল্য ইংরেজিভাষী দেশসমূহ এবং ফরাসিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক সংহতি সৃষ্টি পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতাসূচক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতায় যা দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ দেশপ্রেম, যা, যদিও এর মূল নিহিত ইহুদি সবিশেষত্ব এবং রোমানদের রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তিতে, জন্ম নিয়েছে আধুনিককালে, প্রথম সূচিত হয় ইংরেজদের আর্মাডা৫ প্রতিরোধের ভেতর এবং এর প্রথম সাহিত্যিক প্রকাশ ঘটে শেক্সপিয়ারে। ধর্মযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে প্রধানত দেশপ্রেমভিত্তিক রাজনৈতিক সংহতি পশ্চিমে দ্রুত বাড়ছে। এ ব্যাপারে জাপান অসাধারণ যোগ্য ছাত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন জাপানে ছিল দাঙ্গাবাজ সামন্ত ব্যারনের দল, যাদের তুলনা গোলাপের যুদ্ধাকালীন ইংল্যান্ডের অসংখ্য ব্যারন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র এবং বারুদের সাহায্যে শোগুন অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে; (জাহাজে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদের সঙ্গে জাপানে ধর্ম প্রচারকরাও এসেছিল); এবং ১৮৬৮ সাল থেকে শিক্ষা ও শিন্টো ধর্মের সাহায্যে সরকার পশ্চিমের মতোই একটা সমসত্ত্ব, দৃঢ়সংকল্প এবং একতাবদ্ধ জাতি গঠনে সফল হয়।