তবে প্রথমেই একটা প্রশ্ন: সভ্যতা কী? আমি বলবো এর প্রথম আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হলো পূর্বচিন্তন। বাস্তবিকপক্ষে পূর্বচিন্তনই মানুষকে বন্যপশু থেকে আলাদা চিহ্নিত করে, বয়স্কদের পৃথক করে শিশুদের থেকে। তবে পূর্বচিন্তন যেহেতু মাত্রার ব্যাপার, অতএব আমরা বেশি কিংবা কম সভ্য জাতি এবং সময়কালকে পূর্বচিন্তনের প্রাপ্ত পরিমাণ অনুসারে পৃথক করে চিনতে পারি। এবং পূর্বচিন্তন সূক্ষ্ম পরিমাপে প্রায় সমর্থ। আমি বলবো না যে একটা গোষ্ঠীর গড় পূর্বচিন্তন কৌতূহলের পরিমাণের ব্যস্তানুপাতিক, অবশ্য এই মতটিও গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আমরা বলতে পারি যে, যে কোনো কাজে পূর্বচিন্তনের মাত্রা তিনটি উপাদান দ্বারা পরিমাপ করা যায়; বর্তমানে যন্ত্রণা, ভবিষ্যৎ সুখ এবং এই দুটির মধ্যে বিরতির সময় পরিধি। অর্থাৎ পূর্বচিন্তন পাওয়া যায় ভবিষ্যৎ সুখ দিয়ে বর্তমান যন্ত্রণা প্রথমে ভাগ করে, অতঃপর মধ্যেকার বিরতিকাল দিয়ে গুণ করতে হবে। আবার ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের মধ্যে তফাত রয়েছে। একটি অভিজাত কিংবা ধনিক সম্প্রদায়ে এক ব্যক্তি বর্তমান যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, অপরজন ভোগ করে ভবিষ্যৎ সুখ। এতে সামষ্টিক পূর্বচিন্তন সহজতর হয়ে পড়ে। এই অর্থে শিল্পায়নের সকল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করে সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের উচ্চমাত্রা; যারা তৈরি করেন রেলপথ, পোতাশ্রয় কিংবা জাহাজ তাদের কাজের সুবিধা কয়েক বছর পর লাভ করা যায়।
এটা সত্য যে আধুনিক জগতের কোনো ব্যক্তি এতটা পূর্বচিন্তন দেখান নি যতটা দেখিয়েছেন প্রাচীন মিসরবাসীরা মৃতদেহ মমি করে, কারণ এই কাজটি তারা করেন যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা হলো ঐ মমি দশ হাজার বছর পর পুনরুজ্জীবিত হবে। এখণ আমি আর একটি উপাদানের সন্ধান পেলাম যা সভ্যতার জন্য আবশ্যিক : জ্ঞান। কুসংস্কারভিত্তিক পূর্বচিন্তনকে পুরোপুরি সভা বলে গণ্য করা যায় না; অবশ্য এটা মনের এমন অভ্যাস জন্ম দিতে পারে যা সত্যকার সভ্যতা বিকাশের জন্য আবশ্যিক। উদাহরণ, এই যে শুদ্ধাচারীদের (পিউরিটান) অভ্যাস ছিল পরবর্তী জীবনের জন্য সুখ বিসর্জন, তা নিঃসন্দেহে পুঁজি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। যে পুঁজি শিল্পায়নের জন্য ছিল খুবই দরকারি। তাহলে আমরা সভ্যতার সংজ্ঞা এইভাবে নিরূপণ করতে পারি: জীবনের একটা রীতি, যা জ্ঞান ও পূর্বচিন্তনের সমন্বয়ে গঠিত।
এই অর্থে সভ্যতা শুরু হয়েছে কৃষিকার্য এবং রোমন্থক জন্তু পোষ মানানোর সঙ্গে। এই কিছুকাল আগেও কৃষিজীবী এবং পশুপালক জনগোষ্ঠীর লোকেরা পরিষ্কারভাবে পৃথক ছিল। আমরা বাইবেলের আদিপুস্তকে পড়ি কীভাবে ইস্রায়িলীদের গোশেন প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে হয়, মূল মিশরে তাদের জায়গা হয়নি, কারণ মিশরবাসীরা পেশা হিসেবে পশুপালনকে একেবারে পছন্দ করেনি, এ বিষয়ে তাদের ছিল ঘোর আপত্তি: পরে যোসেফ আপন ভ্রাতাদের ও পিতার স্বজনকে বললেন, আমি গিয়ে ফেরাউনকে জানাবো, তাকে বলবো, আমার ভাইয়েরা এবং পিতার স্বজনেরা কেনান দেশ থেকে আমার কাছে এসেছে; তারা মেষপালক, পশু রক্ষণাবেক্ষণ তাদের কাজ; এবং তাদের গোমেমাদি ও সর্বস্ব সঙ্গে এনেছে। এতে ফেরাউন যখন তোমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের পেশা কী? তখন তোমরা বলবে, আপনার এই দাসগণ পুরুষানুক্রমে এবং অদ্যাবধি পশুপালন করে আসছে; ফলে তোমরা গোশেন প্রদেশে বাস করতে পারবে; কারণ মিশরবাসীরা পশুপালকদের একদম ঘৃণা করে। মি. হুকের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, পশুপালক মঙ্গলদের প্রতি চিনাদেরও অনুরূপ মনোভাব কাজ করেছে। মোটের উপর, কৃষিকাজ সব যুগের উচ্চতর সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেছে। ধর্মের সঙ্গেও ছিল এর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কিন্তু গোষ্ঠীপতিদের গো-মহিষাদির প্রভাবও ব্যাপক ছিল ইহুদি ধর্মের উপর, অতঃপর উক্ত প্রভাব খ্রিষ্টধর্মের উপর বর্তায়। কেইন ও আবেলের গল্প এক খণ্ড প্রচারণা মাত্র, এতে দেখানো হলো যে মেষপালকরা কৃষিজীবীদের চেয়ে পুণ্যবান। তথাপি এই সম্প্রতিকাল পর্যন্তও সভ্যতা প্রধানত কৃষিকার্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।
আমরা এতক্ষণ এমন বিষয় বিবেচনার মধ্যে আনিনি যা প্রতীচ্যের সভ্যতাকে অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতা থেকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেমন ভারত, চীন, জাপান এবং মেক্সিকোর সভ্যতা থেকে। বস্তুত বিজ্ঞানের উদ্ভবের আগে এই পার্থক্য খুবই কম ছিল। বিজ্ঞান ও শিল্পায়ন আজকের প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতার চিহ্ন; কিন্তু আমি প্রথমে বিবেচনা করব শিল্প বিপ্লবের আগে আমাদের সভ্যতা কেমন ছিল।
আমরা যদি পশ্চিমী সভ্যতার উৎপত্তির কারণগুলোতে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাবো মিশর ও ব্যাবিলন থেকে এটা যা গ্রহণ করেছে তা প্রধানত সকল সভ্যতারই বৈশিষ্ট্য এবং তা কেবল পশ্চিমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়। পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতা শুরু হয় গ্রিকদের সঙ্গে, এই গ্রিকরা অবরোহী চিন্তার অভ্যাস এবং জ্যামিতি উদ্ভাবন করে। তাদের অন্যান্য গুণ হয় ছিল না কিংবা থাকলে তা অন্ধকার যুগে হারিয়ে যায়। সাহিত্য এবং শিল্পকলায় হয়তো তাদের শ্রেষ্ঠতা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন প্রাচীন জাতিসমূহ থেকে তাদের বিভিন্নতা খুব গভীর ছিল না। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা গুটিকয় ব্যক্তির জন্ম দেয়, এখানে আমরা আর্কিমিডিস-এর নামোল্লেখ করতে পারি, যিনি আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে অনুমান করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারা কোনো মতবাদী গোষ্ঠী কিংবা ঐতিহ্য নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। গ্রিকদের সভ্যতার একটা অতি সুস্পষ্ট অবদান হলো অবরোহী যুক্তি এবং বিশুদ্ধ গণিত।