নেহাৎ অপরাধী না হলে যেহেতু সবাই মাইনে পাবে, এবং শিশুদের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, কাজেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না (যুদ্ধের বিপদ যতদিন থাকবে সেটা ব্যতিক্রম ধরে)। স্ত্রীরা স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হবে না, সন্তানদেরকে তাদের অভিভাবকদের ত্রুটির জন্য ভুগতে দেয়া হবে না। কোনো ব্যক্তি আর্থিক কারণে অপর কোনো ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হবে না, সবাই হবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।
যদি সমাজতন্ত্র কতকগুলো সভ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়, কিন্তু অধিকাংশ দেশগুলোতে নয়, তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যাবে এবং ব্যবস্থাটার পূর্ণ সুবিধা বাস্তবায়ন করা যাবে না। তবে আমি একটা কথা সুনিশ্চিত বলেই মনে করি যে দেশগুলো সমাজতন্ত্র গ্রহণ করবে সে দেশগুলো আক্রমণাত্মক সমরতন্ত্রী আর থাকবে না এবং অন্য দেশের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য আন্তরিকভাবে যোগ দেবে। গোটা সভ্য জগতে সমাজতন্ত্র সার্বজনীন হয়ে ওঠার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার যুক্তি অতিক্রম করে যুদ্ধের অভিলাষের সম্ভবত যথেষ্ট বল থাকবে না।
আমি পুনরায় বলি: সমাজতন্ত্র শুধু সর্বহারার জন্য মতবাদ নয়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ঠেকিয়ে এই তন্ত্র কিছু অতি ধনী বাদ দিয়ে সবার সুখ বর্ধন করবে; এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটা যেমন প্রথম শ্রেণির যুদ্ধ ঠেকাতে সক্ষম, তেমনি সমগ্র জগতে অপরিমেয় সমৃদ্ধি আনয়ন করবে। শিল্পপতিরা যে বিশ্বাস করে আর একটা মহাযুদ্ধ হলে তারা লাভবান হবে, সে সম্পর্কে বলা যায় যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক যুক্তি দ্বারা সত্য বলে মনে হলেও তা বাতিকগ্রস্ত লোকের অব্যবস্থচিত্ত বিভ্রম মাত্র।
বাস্তব ব্যাপারটা তাহলে কি এই যে (কম্যুনিস্টরা যেমন মনে করেন) সমাজতন্ত্র সার্বজনীনভাবে হিতকর এবং সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য; তাছাড়া প্রচলিত অর্থব্যবস্থা যেহেতু ভেঙে পড়েছে এবং আর একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হলে বিপদ আরো ঘনিয়ে আসবে, ফলে সমাজতন্ত্র জরুরি হয়ে পড়বে? ব্যাপারটা কি আমরা এই যে, সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব সর্বহারা এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশই শুধু উপলব্ধি করতে সক্ষম? এবং এই তন্ত্র একটি রক্তক্ষয়ী, অনিশ্চিত, ধ্বংসাত্মক শ্রেণি-যুদ্ধ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা যাবে না? আমি নিজের পক্ষ থেকে বলতে পারি, এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র পুরাকালীন অভ্যাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, সুতরাং আবেগগত বিরোধিতা দেখা দেয়, যা কেবল ক্রমান্বয়ে উত্তরণ সম্ভব। শুধু কি তাই, বিরুদ্ধপক্ষের মনে সমাজতন্ত্র নাস্তিক্যবাদ এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের সঙ্গে জড়িত। অথচ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। এটি একটি অর্থনৈতিক মতবাদ এবং একজন সমাজতন্ত্রী খ্রিস্টান, মুসলমান, বুদ্ধধর্মাবলম্বী কিংবা ব্রহ্মের উপসনাকারী হতে পারেন। সন্ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে বলা যায়, সম্প্রতিকালে বহু সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে, এবং যেখানে সমাজতন্ত্র এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রূপে আসে। ভয় করা হয় সমাজতন্ত্র পূর্ববর্তী শাসনের হিংস্রতা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুটা লাভ করবে। কিন্তু যে দেশগুলো এখনও কতকটা মুক্ত চিন্তা এবং বাক স্বাধীনতার অনুমতি দেয়, সেখানে উদ্দীপনা ও সহনশীলতার সম্মিলন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রও অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার কাছে বুঝেসুঝে গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা যায়। সে সময় এলে যদি সংখ্যালঘু অবৈধভাবে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে তাহলে সংখ্যাগুরুকে অবশ্যই বিদ্রোহ দমনের জন্য বল প্রয়োগ করতে হবে। যেক্ষেত্রে প্ররোচনা সম্ভব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মন এখনও তৈরি হয়নি সেখানে বলপ্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে না; সংখ্যাগুরুর মন তৈরি থাকলে ব্যাপারটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায়, যদি না যথেচ্ছাচারী লোকেরা বিদ্রোহ করে বসে। এ ধরনের বিদ্রোহ দমনের জন্য যে কোনো সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং গণতান্ত্রিক দেশে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক দলের মতো সমাজতন্ত্রীদেরও বলপ্রয়োগের অধিক সুযোগ থাকবে না এবং যদি সমাজতন্ত্রীদের অধিকারে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকেও, পূর্ববর্তী প্ররোচনার জন্যই কেবল তা অর্জন করতে পারে। কোনো কোনো মহলে যুক্তি দেখানো নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে যে, যদিও সমাজতন্ত্র হয়তো এক সময় সাধারণ প্রচারণার মাধ্যমে কায়েম করা সম্ভব হতো, ফ্যাসিজমের উদ্ভব এটা অসম্ভব করে তুলেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দেশগুলোর বেলায় এটা অবশ্যই সত্য, কারণ শাসনতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা উক্ত দেশগুলোতে সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দল রয়েছে; গ্রেট ব্রিটেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিস্টদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না যে তারা পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে। এই কিছুদিন আগেই তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু শ্রমিক দলের পুনরুজ্জীবন ঠেকানোর জন্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থা বিস্তার রোধের জন্য যথেষ্ট সন্ত্রাসমূলক ছিল না। সমাজতন্ত্রীদের অতি সত্তর গ্রেট ব্রিটেনে সংখ্যাগুরু হওয়া অসম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, অতএব তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে; এবং অতি ভীরুর দল এই অসুবিধাগুলো স্বীয় দলের কার্যক্রম পরিত্যাগের জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, সৎ প্রচারণা অনিবার্য কারণে মন্থর ব্যাপার হলেও সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা অবশ্যই দ্রুত ও হঠাৎ করে সম্পন্ন হবে। কিন্তু এখনই এমন কোনো জোরালো কারণ ঘটেনি যে ধরে নিতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে, অন্য কোনো পদ্ধতি সফল হবে এমন মনে করার যুক্তি আরো কম। অপরপক্ষে, অনিয়মতান্ত্রিক উৎপীড়নমূলক যে কোনো উপায় শুধু ফ্যাসিবাদ প্রসারেই সহায়তা করবে। গণতন্ত্রের দুর্বলতা যাই হোক না কেন, এর মাধ্যমেই এবং সমাজতন্ত্রে জনপ্রিয় আস্থার জোরেই কেবল আশা করা যায় যে গ্রেট ব্রিটেন কিংবা আমেরিকায় সমাজতন্ত্র সফল হবে। যে কেউ গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা দুর্বল করার চেষ্টা করেন, তিনি ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজম নয়, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবেন।
০৮. প্রতীচ্য সভ্যতা
সত্যিকার পরিপ্রেক্ষিতে একজনের পক্ষে নিজের সভ্যতাকে দেখা কোনো মতেই সহজ কাজ নয়। এই লক্ষ্যে পৌঁছার কেবল তিনটি উপায় রয়েছে; ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান; আমি এ বিষয়ে যা প্রস্তাব করবো তাতে এই তিনটি উপাদানের সংমিশ্রণ থাকবে; তবে এই তিনটির কোনো একটি বস্তুগত তদন্তের ক্ষেত্রে বিরাট কোনো সাহায্য হবে না। কারণ পর্যটকরা তাদের কৌতূহলের বস্তুকেই কেবল দেখতে পান; উদাহরণত, মার্কো পলো একবারও দেখতে পাননি যে চীনা মহিলাদের পদযুগল ক্ষুদ্রাকৃতি। ইতিহাসকারগণ ঘটনাবলি সজ্জিত করেন নিজেদের অর্জিত অভ্যাস অনুসরণে; রোমকে সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের জন্য নানা কারণ দেখানো হয়েছে, যেমন সাম্রাজ্যবাদ, খ্রিষ্টধর্ম, ম্যালেরিয়া, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দেশান্তরগমন। শেষ দুটি কারণ যথাক্রমে আমেরিকার পাদরি ও রাজনীতিবিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নৃবিজ্ঞানী ঘটনা নির্বাচন এবং ব্যাখ্যা করেন তার সময়ে প্রচলিত সংস্কার অনুসরণে। আমরা যারা ঘরকুনো তারা বন্য লোকদের সম্পর্কে কী জানি? রুশোপন্থীরা বলেন তারা মহৎ, আবার সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তারা নির্দয়, ধর্মপুষ্ট মনের নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, তারা পুণ্যবান পারিবারিক মানুষ, আবার বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের প্রবক্তরা বলেন, তাদের জীবনাচরণে মুক্ত যৌনতার প্রাধান্য রয়েছে; স্যার জেমস ফ্রেজার বলেন, তারা সবসময় তাদের ঈশ্বরকে হত্যা করে। এদিকে অন্যেরা বলেন, তারা সর্বদাই দীক্ষা-কর্মানুষ্ঠানে নিয়োজিত। সংক্ষেপে, আদিম বা বন্য লোক নৃবিজ্ঞানীদের বাধিত করেন, অর্থাৎ নৃবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের জন্য যা যা দরকার তারা তাই করেন। এই সব ক্রটি সত্ত্বেও ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, এবং আমাদের এসবই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে হবে।