ইস্পাত শিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থঘটিত অন্যান্য শিল্পকারখানা, কিছুতেই তাদের উদ্দেশ্যের অনুকূলে বৃহৎ জাতিসমূহের সেবা পাবে না যদি তারা জনগণের সঠিক আবেগের কাছে আবেদন রাখতে না পারে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে তারা ভীতির কাছে আবেদন রাখতে পারে; জার্মানিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কাছে; এবং এই অভীষ্টগুলো উভয়পক্ষের জন্য সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পর্কে যদি শান্ত মাথায় বিবেচনা করা যায় তাহলে উভয় পক্ষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ন্যায়সঙ্গত চুক্তি প্রত্যেককে সুখী করবে। এমন কোনো কল্যাণকর যুক্তি নেই যে জার্মানদের অন্যায় সয়ে যেতে হবে। কিংবা অন্যায় যদি দূর করা হয় তবে তাদের যুক্তিসঙ্গত কোনো অজুহাত থাকবে না এমন আচরণ করার, যাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হবে। কিন্তু শান্ত এবং যুক্তিযুক্ত হওয়ার জন্য যখনই কোনো প্রচেষ্টা নেয়া হয় তখনই দেশপ্রেম ও জাতীয় মর্যাদার প্রতি আবেদনের রূপ ধরে অপপ্রচার হস্তক্ষেপ করে। অর্থাৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। দুনিয়াটা সুরাপানে মত্ত অবস্থায় আছে, সে মাতাল সংস্কারের জন্য উসুক, কিন্তু সে এমন দয়ালু বন্ধুদের দ্বারা পরিবৃত যারা তাকে সব সময় সুরা যোগাচ্ছে, ফলে সে স্থায়ীভাবে মত্ত অবস্থায় থাকছে। এক্ষেত্রে দয়ালু বন্ধুরা টাকার পাহাড় গড়ছে তার দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা কাজে লাগিয়ে। এখন তার প্রথম কাজ হবে এদেরকে অপসারণ করা। এই অর্থেই কেবল বলা যায় যে আধুনিক পুঁজিবাদ যুদ্ধের জন্য দায়ী বা কারণ, কিন্তু এটাই সমগ্র কারণ নয়। তবে এটা কারণগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা যোগায়। এই অবস্থাটা যদি আর না থাকত তাহলে উদ্দীপনার অনুপস্থিতির জন্য মানুষ খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধের অসঙ্গতি বুঝে যেত এবং এমন ন্যায়সঙ্গত চুক্তিতে পৌঁছাত যে, ভবিষ্যতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি সম্ভব হতো না।
ইস্পাতশিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলো যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে, অর্থাৎ এমন কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় যে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলোতে জাতীয়করণ সম্ভবত যুদ্ধের আসন্ন বিপদ দূর করার জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ ইস্পাতশিল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যদি সরকারের হাতে থাকে এবং সরকার যদি গণতান্ত্রিক হন, তাহলে এর পরিচালনা শিল্পের স্বার্থে না হয়ে জাতির স্বার্থে হবে। পাবলিক ফাইন্যান্সের লেন-দেনের হিসাবপত্রে, ইস্পাতশিল্প গোষ্ঠী সমাজের অন্যান্য অংশের ক্ষতি করে যে মুনাফা অর্জন করবে তা অন্যত্র ক্ষতি দ্বারা শোধরানো হবে, এবং যেহেতু একটি পৃথক কারখানার লাভ বা ক্ষতির জন্য কোনো ব্যক্তির আয় ওঠানামা করবে না, তাই কারো অভিলাষ হবে না জনগণের খরচে ইস্পাতশিল্পের স্বার্থ সম্প্রসারণ। বোঝা যাবে যে, যুদ্ধাস্ত্র বৃদ্ধির জন্য ইস্পাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ক্ষতি হচ্ছে, কারণ এতে জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে। এইভাবে সর্বসাধারণ এবং ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে মিলন ঘটবে, এবং ভ্রমাত্মক অপপ্রচারের অভিলাষ আর থাকবে না।
এবার আমাদের বিবেচনাধীন অন্যান্য অকল্যাণের প্রতিকার কীভাবে সমাজতন্ত্র করবে সে সম্পর্কে কিছু বলা যায়।
শিল্পে মুনাফার পিছনে ছোটার পথনির্দেশক অভিলাষের স্থান নেবে সরকারি পরিকল্পনা। সরকার হিসেবে ভুল করতে পারেন, কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে ভুলটা কম করার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সরকারের এ ব্যাপারে পূর্ণতর জানাশোনা এবং বিচারবুদ্ধি থাকবে। রাবারের উচ্চমূল্যের সময় যার পক্ষে সম্ভব সেই রাবার বৃক্ষ রোপণ করেছে, ফলে কয়েক বছর পর রাবারের মূল্য ভীষণ পড়ে যায়, তখন দেখা গেল বিশেষ প্রয়োজনে রাবার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে চুক্তিতে পৌঁছা দরকার। একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ, যার হাতে রয়েছে সকল পরিসংখ্যান, এই ধরনের ভুল হিসাব বন্ধ করতে পারে। তথাপি, নতুন উদ্ভাবনের মতো অদৃশ্য কারণসমূহ সর্বাধিক সযত্নে তৈরি হিসাবও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সমগ্র গোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে নতুন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে লাভবান হতে পারবে। সমাজতন্ত্রের অধীনে যে-কোনো সময় বেকারদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বেকারত্বের ভীতি এবং নিয়োগকর্তা ও কর্মীর ভেতর পারস্পারিক সন্দেহের জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যখন একটি কারখানায় অবক্ষয় শুরু হয় এবং অপর একটি কারখানা প্রসারিত হতে থাকে তখন কনিষ্ঠতর কর্মীদের অবনতিশীল কারখানা থেকে সরিয়ে এনে প্ৰসাৰ্যমাণ কারখানায় প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। বেকারত্বের অনেকটা দূর করা যায় শ্রমের সময় কমিয়ে। যখন কোনো ব্যক্তির জন্য কাজই খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখনও সে পূর্ণ মজুরি পাবে, তাকে মজুরি প্রদান করতে হবে তার কাজ করার ইচ্ছার জন্য। যতদূর কাজ করতে বাধ্য করার দরকার হবে, তা করতে হবে অপরাধ আইনের প্রয়োগ দ্বারা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সাহায্য নেয়।
যারা পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের উপর কাজটা ছেড়ে দিতে হবে। সবশেষে ব্যাপারটা নির্ভর করবে জনপ্রিয় মতামতের উপর, স্বাচ্ছন্দ্য এবং অবসরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটা দরকার। যদি প্রত্যেক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করে তবে দিনে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যেত ততটা করা যাবে না। তবে আশা করা যায় প্রযুক্তিগত উন্নতি অংশত অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য এবং অংশত অধিকতর অবসরের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবহার করা যাবে।