এক মুহূর্তের জন্য আমরা কাজের নীতি সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে এবং কুসংস্কার বর্জন করে বিবেচনা করি। প্রত্যেকটি মানুষ প্রয়োজনে, তার জীবৎকালে, মানবশ্রমে উৎপন্ন সামগ্রী নির্দিষ্ট মাত্রায় ভোগ করে। ধরে নিচ্ছি, শ্রমের ব্যাপারটা সর্বোপরি মেনে নেয়া যায় না এবং এটা অন্যায্য যে একটা মানুষ যতটুকু উৎপাদন করবে তার চেয়ে বেশি ভোগ করবে। অবশ্য তিনি সামগ্রী উৎপাদন না করে, উদাহরণত, ডাক্তারদের মতো সেবা দান করতে পারেন; কিন্তু তাকে থাকা ও খাওয়ার বদলে কিছু দিতেই হবে। এ পর্যন্ত কর্তব্যকর্ম অনুমোদন করতেই হবে। তবে এ পর্যন্তই কেবল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে সকল আধুনিক সমাজে এই সামান্যটুকু কাজও অনেকে করেন না। অন্তত যারা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ লাভ করেন কিংবা অর্থ বিয়ে করেন, কিন্তু এ বিষয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। তবে আমি মনে করি না যে, এদের আলস্য অনুমোদন করে যতটা ক্ষতি করা হয় তা শ্রমজীবীদের বেশি কাজ করিয়ে কিংবা অনাহারে রেখে যে ক্ষতি করা হয় তার সমান।
যদি সাধারণ শ্রমজীবীরা দিনে চার ঘণ্টা কাজ করত তাহলে পর্যাপ্ত সামগ্রী সবার জুটত, এবং কেউ বেকার হতেন না-এখানে ধরে নিতে হবে একটা যুক্তিশীল সংগঠন বর্তমান। এই ধারণা ধনবানদের আহত করে, কারণ তারা নিশ্চিত যে এতটা অবসর কীভাবে ভোগ করতে হয় তা শ্রমিকদের জানা নেই। আমেরিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও প্রায়ই দীর্ঘ সময় কাজ করেন; এই ধরনের লোক স্বাভাবিকভাবেই মজুরদের অবকাশের কথা শুনে ক্ষেপে যান; আবার বেকারত্বের কড়া শাস্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই; বস্তুত তারা স্বীয় পুত্রদের অবকাশ যাপনও অপছন্দ করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারা চান পুত্ররা কঠোর পরিশ্রম করুক, তাদের সভ্য হবার মতো সময় নাই-ই বা থাকল, অথচ তাদের স্ত্রী ও কন্যারা যদি একেবারেই কাজ না করেন তাহলে তারা কিছু মনে করেন না। প্রয়োজনহীনতার প্রতি উন্নাসিক সমর্থন আভিজাতিক সমাজের নর-নারীর অনুমোদন লাভ করে; কিন্তু ধনিক শ্রেণির শাসন ব্যবস্থায় এটা নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে; যা হোক এটা কোনো মতেই কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে চলে না।
বিজ্ঞতার সঙ্গে অবকাশের ব্যবহার, মানতেই হবে, সভ্যতা ও শিক্ষার ফসল। যে লোক সারা জীবন প্রতি দিন দীর্ঘ সময় কাজ করে সে যদি হঠাৎ অলস হয়ে যায় তবে সে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ অবকাশের অভাবে একজন লোক জীবনের অনেক ভালো ব্যাপার থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এমন কোনো কারণ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না জনগণ কেন এই বঞ্চনা ভোগ করবে; কেবল নির্বোধ কৃচ্ছতাসাধন, যা একান্তই নানা জাতের, আমাদের বহুল পরিমাণে কর্মে বাধ্য করে, যার কোনো প্রয়োজন নেই।
যে নতুন নীতি রুশ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে অনেক কিছু রয়েছে যা প্রতীচ্যের প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন, আবার এমন জিনিসও রয়ে গেছে যার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শাসক শ্রেণির মনোভাব এবং বিশেষত যারা শিক্ষাক্ষেত্রে অপপ্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত তারা যা শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচার করে, তা প্রায় একই ধরনের, যা জগতের সকল শাসক শ্রেণি প্রায় সব সময়ই প্রচার করে আসছে, এবং তাকেই বলা হয় সৎ দরিদ্র। রুশদেশে পরিশ্রম, মিতাচার, সুদূর সুবিধার জন্য দীর্ঘ সময় কাজের ইচ্ছা, এমনকি কর্তৃপক্ষের কাছে আনুগত্য, এসবেরই পুনরাবির্ভাব ঘটেছে; উপরন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসকের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে, যাকে নতুন নামে ডাকা হয় বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতা বলে। অর্থাৎ মহান ঈশ্বরের সিংহাসন এখন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দখলে।
রুশদেশে সর্বহারাদের বিজয় এবং অপরাপর কিছু দেশের নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকারীদের বিজয়ের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাপারে মিল রয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে, পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষের সাধুতাকে উন্নততর বলে মেনে নিয়েছে। এবং মেয়েদের হীনতাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে, সাধুতা ক্ষমতার চেয়ে অধিক বাঞ্ছনীয়। সব শেষে, নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের উভয়দিক রক্ষা করতে হবে, আর যেহেতু এই আন্দোলনের সম্মুখভাগের নেতৃবৃন্দ পুণ্যের বাঞ্ছনীয়তা সম্পর্কে পুরুষরা যা বলেছে তার সবই বিশ্বাস করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল্যহীনতা সম্পর্কে যা বলেছে তা মেনে নেয়নি। কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছে রুশদেশে। যুগের পর যুগ, ধনীরা এবং তাদের মোসাহেবদল সৎ পরিশ্রম সম্পর্কে প্রশংসা করে অনেক কিছু লিখেছে, প্রশংসা করেছে সাদাসিধে জীবনের, প্রচার করেছে এমন ধর্মের যে ধর্ম শিক্ষা দেয় যে ধনীদের চেয়ে গরিবদের স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর এবং সর্বোপরি কায়িক শ্রমিকদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে স্থানিক বস্তুর অবস্থা পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে। যেমন পুরুষরা মেয়েদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে, তারা যৌন-দাসত্ব থেকে বিশেষ মহত্ত্ব লাভ করে। রুশ দেশে কায়িক-শ্রম সম্পর্কিত এতসব শিক্ষা খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে, ফলে গতর-খাটানো শ্রমিকরা অন্যান্যদের চেয়ে অধিক সম্মান পেয়ে থাকে। বস্তুত পুনরুজ্জীবনবাদী আবেদন একই কারণে করা হয়, তবে লক্ষ্য পুরাতন নয়। আবেদনের লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের বিশেষ কাজের জন্য তৈরি রাখা। কায়িক শ্রম যুবকদের সামনে আদর্শ হিসেবে খাড়া করা হয়, এবং এটা তাদের সকল নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি।