৯. যুদ্ধ
আমি এবার সমাজতন্ত্রের পক্ষে সর্বশেষ ও সর্বাধিক শক্তিশালী যুক্তি প্রসঙ্গে আসছি; যুদ্ধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা। যুদ্ধের সম্ভাবনা কিংবা এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করে আমি সময় নষ্ট করবো না, কারণ এগুলো নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া যায়। আমার আলোচনা দুটি প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো:
১. বর্তমানে যুদ্ধের বিপদ কতটা পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কাণ্বিত?
২. সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিপদ কতটা দূর করবে?
যুদ্ধ সুপ্রাচীন ব্যাপার, পুঁজিবাদ এর সূচনা করেনি। তবে যুদ্ধের কারণ সব সময়ই প্রধানত ছিল অর্থনৈতিক। অতীতকালে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি, রাজা রাজড়াদের উচ্চাভিলাষ এবং সমর্থ জাতি কিংবা উপজাতির সম্প্রসারণবাদী দুঃসাহসিক অভিযানপ্রিয়তা। সাত বছরের যুদ্ধের মতো ঘটনায় এই উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইউরোপে এই যুদ্ধ ছিল রাজবংশীয় (dynastic), অপরদিকে আমেরিকা এবং ভারতে জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব। রোমকরা যে রাজ্য জয় করতে পেরেছে তা শুধু তাদের সমরনায়ক ও সেনাদলের (Legionaries) অর্থ লাভের আকাঙ্ক্ষার জন্য। আরব, হুন ও মঙ্গোলিয়দের মতো পশুপালক গোষ্ঠীগুলো পুনঃপুন রাজ্য জয়ে বেরিয়েছে। পূর্বেকার চারণভূমির অপর্যাপ্ততার জন্য। এবং সব সময়ই, যুদ্ধ করা সহজ হয়েছে এজন্য যে সমর্থ পুরুষরা বিজয় নিশ্চিত মনে করেছে। তারা যুদ্ধ করে আনন্দও পেতেন, অপরদিকে রমণীরা পৌরুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রশংসা করেছেন। ব্যতিক্রমও ছিল, সম্রাট যখন বলপূর্বক তাদের ইচ্ছা আরোপ করতে পারতেন চৈনিক এবং পরবর্তী রোমক সাম্রাজ্যে যেমন ঘটেছে)। যদিও যুদ্ধ আদিমকালের সূচনা থেকে বহুপথ পরিভ্রমণ করেছে, তবু সেই প্রাচীন অভিলাষ এখনও আছে, যারা যুদ্ধের অবসান চান। তাদের অবশ্যই তা স্মরণে থাকতে হবে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রক্ষাকবচ হতে পারে। কিন্তু সকল প্রধান সভ্য রাষ্ট্রে জাতীয় সমাজতন্ত্র কায়েম হলে যুদ্ধের সম্ভাবনা কেন অনেকটা হ্রাস করতে পারবে তা এখন আমি দেখাতে চেষ্টা করবো।
যদিও যুদ্ধের প্রতি দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না সভ্য দেশগুলোর এক শ্রেণির লোকের ভেতর এখনও কাজ করে, তবু শান্তির ইচ্ছা সৃষ্টিকারী অভিপ্রায় গত কয়েক শতাব্দীর তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ বুঝতে পেরেছে গত যুদ্ধ এমনকি বিজয়ী পক্ষের জন্যও সমৃদ্ধি বয়ে আনে নি। তারা বুঝতে পারে যে, পরবর্তী যুদ্ধে বেসামরিক জীবননাশের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার বিশালতার তুলনা কোনো যুগের সঙ্গে চলবে না। তিরিশ বছরের যুদ্ধের পর থেকে তীব্রতায়ও তার তুল্য হবে না, তাছড়া সম্ভবত এই ক্ষতি শুধু এক পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা ভীত যে প্রধান শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সমগ্র একটা মহাদেশের সভ্যতা হবে বিনষ্ট। বিশেষত, ব্রিটিশ জনগণ সচেতন যে তারা যুগ-যুগান্ত ধরে বহিঃআক্রমণ থেকে মুক্তি লাভের যে সুবিধা ভোগ করেছে তা হারিয়েছে। এইসব বিবেচনা থেকে গ্রেট ব্রিটেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রগাঢ় আসক্তি জন্মেছে, অন্যান্য দেশগুলোতেও অনুরূপ অনুধাবন কাজ করছে, তবে হয়তো তীব্রতা কিছুটা কম। তাহলে, এতসব সত্ত্বেও, যুদ্ধের বিপদ কেন আসন্ন? প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্যই ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা, যার জন্য জার্মানিতে সামরিক জাতীয়তাবাদ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু একটা নতুন যুদ্ধ সম্ভবত ১৯১৯ সালের চেয়ে কঠোর সন্ধির জন্ম দেবে, ফলশ্রুতিতে পরাস্ত পক্ষে আরো উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এই বিরামহীন ওঠা-নামার ভেতর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কেবলমাত্র জাতিসমূহের শত্রুতার হেতুগুলো দূরীভূত করার মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। একালে এ হেতুগুলো প্রধানত খুঁজে পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে। সুতরাং এর বিলুপ্তি মৌলিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মধ্যে নিহিত।
অর্থনৈতিক শক্তি কীভাবে যুদ্ধে ইন্ধন জোগায়, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পকে আমরা তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। মূল ঘটনা হলো, আধুনিক কৌশল অবলম্বন করে প্রচুর পরিমাণ উৎপাদন করলে প্রতি টন উৎপাদনে যে খরচ পড়ে তা স্বল্প পরিমাণ উৎপাদনের চেয়ে অনেক কম। ফলে বাজার যদি বিরাট হয় তাহলে মুনাফা আসে, অন্যথায় নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত শিল্পের দেশীয় বাজার অন্যান্য দেশের চেয়ে আকারে অনেক বড় বলে এ যাবৎকাল রাজনীতি নিয়ে কোনো প্রকার অসুবিধায় পড়েনি, কেবল প্রয়োজনে নৌশক্তি নিরস্ত্রীকরণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বন্ধে হস্তক্ষেপ করেছে, তার বাইরে কিছু করেনি। কিন্তু জার্মান, ফরাসি এবং ব্রিটিশ ইস্পাত শিল্পগুলোর বাজার তাদের কারিগরি প্রয়োজনে যে চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর। অবশ্য তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারত, কিন্তু এতে কিছু অর্থনৈতিক আপত্তি রয়েছে। ইস্পাতের চাহিদার একটা বিরাট অংশ যুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং জাতীয়তাবাদের দরুন ইস্পাত শিল্প লাভবান হয়, জাতীয় অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধিতেও তাদের লাভ। উপরন্তু Comite des Fores এবং জার্মান ইস্পাত সংস্থা আশা করে, মুনাফা ভাগাভাগি না করে, যুদ্ধ দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করতে; এবং যেহেতু যুদ্ধের ব্যয় মূলত অন্যের ঘাড়ে চাপবে, অতএব তারা মনে করে যুদ্ধের ফলাফল তাদের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক হতে পারে। হয়তো তাদের এই হিসেবে ভুল আছে। কিন্তু এই ভুল ক্ষমতামদমত্ত সুঃসাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী লোকের জন্য স্বাভাবিক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোরেন। অঞ্চলের আকরিক এক সময় জার্মানির অধিকারে ছিল, বর্তমানে ফ্রান্সের দখলে, ফলে দুদেশের মধ্যে শক্রতা বেড়েই চলেছে। এই ঘটনা সব সময় মনে করিয়ে দেয় পরবর্তী যুদ্ধে কী অর্জিত হবে। আর স্বাভাবিকভাবেই জার্মানরা একটু বেশি আক্রমণাত্মক, যেহেতু ফরাসিরা ইতোমধ্যেই গত যুদ্ধের লুষ্ঠিত ধন উপভোগ শুরু করেছে।