৮. অলাভজনক জনসেবা
সভ্য সরকার সূচিত হওয়ার পর থেকে এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে, কিছু কিছু কাজ করতেই হবে, কিন্তু কাজগুলো মুনাফা লাভের ইচ্ছা থেকে এলোমেলো পরিচালনাধীনে ন্যস্ত করা যাবে না। এই সবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুদ্ধ; এমনকি যারা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অযোগ্যতা সম্পর্কে একেবারে সুনিশ্চিত তারাও এমন ইঙ্গিত করেন না যে জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা ব্যক্তিমালিকানাধীন ঠিকাদার গোষ্ঠীর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু আরো অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো জনকর্তৃপক্ষ সমাধা করার প্রয়োজন মনে করে, যেমন পথ-ঘাট, পোতাশ্রয়, বাতিঘর, নগর-উদ্যান, আরো অনুরূপ কিছু কাজ। গত এক শ বছরে বিশেষ ধরনের কাজের জন্য একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তা হলো জনস্বাস্থ্য। প্রথম দিকে অবাধ বাণিজ্যের গোঁড়া অনুসারীরা এর বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বাস্তব যুক্তির কাছে ঐ বিরোধিতা একেবারে টেকেনি। কিন্তু যদি ব্যক্তি উদ্যোগের তত্ত্ব মেনে চলা হতো তাহলে বিরাট অর্থ লাভের সকল নতুন উপায় সম্ভব হতো। প্লেগ রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি প্রচার এজেন্টের নিকট যেতে পারতেন। উক্ত এজেন্ট রেলওয়ে, থিয়েটার কোম্পানি প্রভৃতির কাছে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি পাঠাতেন যে ঐ রোগী তাদের আস্তানায় দেহরক্ষার কথা ভাবছেন যদি না তার বিধবা পত্নীকে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে রোগীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা স্বেচ্ছামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কারণ, সুবিধাটা সর্বসাধারণের, ক্ষতিটা ব্যক্তির।
বিগত শতাব্দীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যই এই ছিল যে জনসেবার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ব্যাপারটা জটিল করা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শিক্ষাব্যবস্থা। রাষ্ট্র কর্তৃক এটা সার্বজনীনভাবে কার্যকরী করার আগে তখনকার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর অভিপ্রায় ছিল আলাদা-আলাদা। মধ্যযুগ থেকে ধার্মিক অভিপ্রায়ে গঠিত কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল, কিছু ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানও ছিল, যেমন কলেজ দ্য ফ্রান্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃতবিদ্য (আলোকপ্রাপ্ত) রেনেসাঁস সম্রাটগণ; পক্ষপাতপুষ্ট দরিদ্ৰশ্রেণির জন্য কিছু দাঁতব্য স্কুলও ছিল। এগুলোর একটিও মুনাফা লোটার জন্য পরিচালিত হয়নি। অবশ্য মুনাফা লাভেল জন্যও কিছু স্কুল পরিচালিত হয়েছে। নমুনা স্বরূপ Dotheboys Hall এবং সালেম হাউসের নাম করা যায়। মুনাফা লাভের জন্য আরো কিছু স্কুল রয়েছে। যদিও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তাদের Dotheboys Hall–এর অনুকরণ করতে বাধা দেয়। এই স্কুলগুলো পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চমান অর্জন নয়, সৎশিক্ষার উপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত। সর্বোপরি শিক্ষার উপর মুনাফা লাভের অভিলাষের প্রভাব নগণ্য।
এমনকি জনকর্তৃপক্ষ যখন প্রকৃতপক্ষে কাজ করে না, তখনও কাজ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বোধ করে। একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি রাস্তা আলোকিত করার কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু এ কাজটি করতেই হবে, এতে লাভ হোক বা না হোক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু নির্মাণকার্য স্থানীয় আইন কিংবা উপবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে সাধারণভাবে স্বীকার করা হয় যে আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। একক নগর-পরিকল্পনা, গ্রেট ফায়ারের পর লন্ডন নগরীর জন্য স্যার ক্রিস্টোফার রেন যেমন প্রকল্প তৈরি করেছিলেন, হয়তো বস্তি ও উপকণ্ঠের বিকটতা ও অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে পারে, আধুনিক শহরগুলোকেও সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং সুখকর করা যায়। এই উদাহরণ থেকে আমাদের এই অত্যন্ত গতিশীল বিশ্বে ব্যক্তি-উদ্যোগের বিরুদ্ধে আরো কিছু যুক্তির ব্যাখ্যা মেলে। যে এলাকাগুলো বিবেচনায় আসবে তার পরিধি এতই বিরাট যে বৃহত্তম বণিক শ্রেণির পক্ষেও এ ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব নয়। উদাহরণত, লন্ডন শহরকে অবশ্যই সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে, কারণ এর অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ শহরের এক প্রান্তে ঘুমায় আর কাজ করে অপর প্রান্তে। সেন্ট লরেন্স ওয়াটারওয়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিশাল স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কারণ দুটি দেশের বিভিন্ন অংশে এটি বিস্তার লাভ করেছে; এরকম ক্ষেত্রে কোনো একক সরকার পর্যাপ্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আগের দিনের চেয়ে এখন যাত্রী, সামগ্রী ইত্যাদি অত্যন্ত সহজে পরিবহন করা যায়, ফলে ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলো, ঘোড়া যখন দ্রুততম পরিবহন মাধ্যম ছিল, সে সময়ের চেয়ে কম স্বয়ম্ভর হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপনাগুলো এতটা গুরুত্ব লাভ করেছে যে, যদি সেগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে নতুন ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে দুর্গবাসী মধ্যযুগের ব্যারনদের। স্পষ্টতই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায় চলনসই আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে না যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ একচেটিয়া সুবিধাদি অপব্যবহারের স্বাধীনতা পায়। পণ্যসামগ্রীর পরিবহন এখন রেলপথের উপর নির্ভরশীল। জনগণের চলাফেরার জন্য পথ-ঘাটের উপর নির্ভরশীলতা আংশিকভাবে ফিরে এসেছে। রেলওয়ে এবং মোটরগাড়ি নগরগুলোর সৃষ্ট করেছে। এইভাবে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তর এলাকায় অধিকতর মাত্রায় জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠ করছে এবং উদ্ভাবনের অগ্রযাত্রার জন্য এর প্রয়োজন বেড়েই চলেছে।