নির্বোধ শ্রেণির লোকের ভঙ্গুর ক্ষমতার উপর নির্ভরতার জন্য এইসব ভোগান্তি হয় নৈতিক, বুদ্ধিগত এবং শৈল্পিকভাবে।
৫. শিক্ষা
বর্তমানে উচ্চতর শিক্ষা, সর্বাংশে না হলেও, প্রধানত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সত্য যে, কখনো কখনো ছাত্রবৃত্তির বদৌলতে শ্রমিক শ্রেণির সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারে, কিন্তু এর জন্য তাদের এত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় যে তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং প্রথম জীবনের প্রতিশ্রুতি কার্যে পরিণত করতে পারে না। আমরা যে অবস্থা গড়ে তুলেছি তাতে সমর্থতার বিরাট অপচয় হয়; মজুর শ্রেণির অভিভাবকের কোনো ছেলে বা মেয়ের অংকে, সংগীতে কিংবা বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণির সমর্থতা থাকতে পারে, কিন্তু সে তার প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ কমই পেয়ে থাকে। উপরন্তু শিক্ষাদর্শ, অন্তত ইংল্যান্ডে, এখন আগাগোড়া চালবাজি সংক্রামিত: ব্যক্তি-পরিচালিত এবং প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ছাত্ররা স্কুল জীবনের প্রতি মুহূর্তে শ্রেণি চেতনা মনে গেঁথে নেয়। আর যেহেতু শিক্ষা ব্যাপারটা প্রধানত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাই রাষ্ট্র স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে, ফলে যতদূর সম্ভব যুবক শ্রেণির বিচার ক্ষমতা ভোঁতা করে দেয় এবং তাদেরকে দুঃসাহসিক ভাবুকতা থেকে রক্ষা করে। অনুমোদন করতে হবে যে, যে কোনো নিরাপত্তাহীন শাসনে এসব হতে বাধ্য এবং এই ব্যাপারটা ইংল্যান্ড ও আমেরিকার চেয়ে রুশদেশে আরো খারাপ। যদিও সমাজতান্ত্রিক শাসন এক সময় যথেষ্ট নিরাপদ হয়ে যেতে পারে, তখন সমালোচনার ভয় আর করবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনের বর্তমান অবস্থায় এটা হওয়া প্রায় অসম্ভব, ক্রীতদাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তো ভিন্ন ব্যাপার, সেখানে মজুর শ্রেণি কোনো শিক্ষাই পাবে না। সুতরাং এটা আশা করা যায় না যে, শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটিগুলোর প্রতিকার করা যাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াই।
৬. নারীমুক্তি এবং শিশু-কিশোরদের কল্যাণ
সাম্প্রতিক কালে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও স্ত্রীদের সংখ্যাগুরু অংশ এখনও আর্থিকভাবে তাদের স্বামীদের উপর নির্ভরশীল। নারীদের এই নির্ভরতা নানাদিক থেকে মজুরশ্রেণি যে নিয়োগকর্তার উপর নির্ভরশীল তার চেয়ে আরো খারাপ। একজন চাকুরে তার চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর জন্য এটি একটি কঠিন কাজ। উপরন্তু গৃহস্থালির কাজে তিনি যতই কঠোর পরিশ্রম করুন না কেন, তিনি কোনো প্রকার মজুরি দাবি করতে পারেন না। এই অবস্থাটা যতদিন চলবে, ততদিন বলা যাবে না যে তারা অর্থনৈতিক সাম্য অর্জনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তবে এটা বোঝা কঠিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কীভাবে এই অবস্থার প্রতিকার করা সম্ভব। দরকার হলো সন্তানের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, স্বামী নয়, আর বিবাহিত মহিলারা শিশুকে স্তন্যদান এবং গর্ভধারণের শেষ অবস্থায় ছাড়া ঘরের বাইরে কাজ করে জীবিকা অর্জন করবে। এর জন্য দরকার স্থাপত্যকর্মের সংস্কার (এই গ্রন্থের অপর একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে), এবং শিশু-কিশোরদের জন্য নার্সারি স্কুল স্থাপন। শিশুদের জন্য, তাদের মায়েদের জন্যও এটা হবে বিরাট আশীর্বাদ। যেহেতু শিশু সন্তানদের জন্য চাই খোলামেলা জায়গা, আলো এবং সুষম খাদ্য, অথচ তা মজুরের বাড়িতে সম্ভব নয়, কিন্তু নার্সারি স্কুলে সস্তায় এগুলোর সরবরাহ সম্ভবপর।
স্ত্রীদের মর্যাদা এবং শিশু-সন্তানের লালন পালনের জন্য এই ধরনের সংস্কার সমাজতন্ত্র ছাড়াও সম্ভব হতে পারে, এখানে-সেখানে অসম্পূর্ণভাবে কাজটা করাও যায়। কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে এবং সম্পূর্ণভাবে কিছুতেই করা যাবে না, সমাজের সাধারণ অর্থনৈতিক রূপান্তরের অংশ হিসেবে যদি না করা হয়।
৭. শিল্পকলা
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর স্থাপত্যশিল্পের কতটা উন্নতি হবে সে সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমার বক্তব্য রেখেছি। আগের কালে পেইন্টিং (চিত্রশিল্প) বিরাট স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেছে এবং অলংকৃত করেছে। অবস্থাটা আবার ফিরে আসতে পারে যদি আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক ভয়ের দরুন দীন আবাসস্থল সম্প্রদায়গত সৌন্দর্যের বাসনার কাছে হার মানে। সিনেমার মতো আধুনিক শিল্প খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। কিন্তু প্রযোজকরা যদি বাণিজ্যিক অভিপ্রায় দ্বারা পরিচালিত হন তাহলে এর সুস্থ বিকাশ সম্ভব হবে না; বস্তুত, অনেকেই এই অভিমত পোষণ করেন যে ইউ এস, এস, আর এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রত্যেক লেখক জানেন বাণিজ্যিক অভিলাষের জন্য সাহিত্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; প্রায় সব প্রাণবান লেখা কোনো না কোনো গোষ্ঠীকে আহত করে, ফলে কাটতি হয় কম। লেখকদের পক্ষে নিজেদের যোগ্যতা গ্রন্থস্বত্বের জন্য প্রাপ্য অর্থ দ্বারা পরিমাপ না করা কঠিন কাজ, এবং যখন বাজে লেখা বিরাট আর্থিক উপহার বয়ে আনে তখন ভালো লেখা সৃষ্টির জন্য লেখকের দরকার করে অস্বাভাবিক চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং গরিব থাকা।
স্বীকার করতে হবে সমাজতন্ত্র অবস্থাটা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু প্রকাশনাশিল্প রাষ্ট্রের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হবে, সুতরাং অনুদারভাবে সেন্সরপ্রথা ব্যবহার রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিরোধিতা থাকবে ততদিন এটা এড়ানো যাবে না। কিন্তু সন্ধিক্ষণ বা অবস্থান্তরকাল যখন শেষ হবে তখন আশা করা যায়, যে বইগুলো যোগ্যতা বিচার করে রাষ্ট্র প্রকাশে ইচ্ছুক হবে না, সে বইগুলোও প্রকাশিত হতে পারবে যদি লেখকগণ ব্যয় নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করে হলেও প্রকাশ করা উচিত মনে করেন। যেহেতু সময়ের সাশ্রয় খুব বেশি হবে না সেহেতু অতিরিক্ত কঠোর শ্রমের দরকার করবে না। কিন্তু এতে সেই লেখকদের বই প্রকাশে বিরত করা যাবে যারা নিজেরা খুব একটা নিশ্চিত নন যে তাদের বইয়ে মূল্যবান কিছু রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বই প্রকাশ করা যেন সম্ভবপর হয়, কিন্তু কাজটা যেন অতি সহজ হয়ে না দাঁড়ায়। বর্তমানে বই খুব বেশি প্রকাশিত হয়। বইগুলোর মানও সেই পরিমাণে কম থাকে।