প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পদের ঈপ্সা জাগে নিরাপত্তার ঈপ্সা থেকে। মানুষ টাকা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করে এই আশায় যে বৃদ্ধ বয়সে এবং হীনবল হলে তারা চলতে পারবে এবং তাদের সন্তানদেরও সামাজিক স্তরের নিচে নামতে হবে না। আগের দিনে এই প্রত্যাশা ছিল যুক্তিপূর্ণ, যেহেতু তখন নিরাপদ বিনিয়োগ নামক একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে নিরাপত্তা বিধানের কোনো ব্যবস্থা নেই; বড়-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পথে বসে; রাষ্ট্র হয় দেউলে, এবং যা কিছু এখনও অস্তিত্বশীল পরবর্তী যুদ্ধে তা ভেসে যাবে। ফলশ্রুতি, অসুখী উদাসীন মেজাজ, যা সম্ভাব্য প্রতিকার সম্পর্কে সুস্থ বিবেচনা কঠিন করে তোলে।
সম্ভাব্য যে কোন প্রকার পরিবর্তনের চেয়ে, যুদ্ধ প্রতিরোধ বাদ দিয়ে, আর্থিক নিরাপত্তা সভ্য সমাজের সুখ বৃদ্ধিতে অধিক সাহায্য করবে। সামাজিক প্রয়োজনের জন্য যতটুকু কাজ করা দরকার তা সকল স্বাস্থ্যবান বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে, কিন্তু তাদের আয় নির্ভর করবে শুধুমাত্র তাদের কাজ করার ইচ্ছার উপর এবং যখন সাময়িকভাবে কোনো কারণে তাদের কাজের দরকার হবে না তখনও তার আয় বন্ধ করা যাবে না। উদাহরণত, একজন চিকিৎসক নির্দিষ্ট মাইনে পাবে, তার মৃত্যুর পরই শুধু ঐ মাইনে বন্ধ হয়ে যাবে। এবং প্রত্যাশা করা হবে না নির্দিষ্ট বয়সের পরও সে কাজ করবে। আর তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তার সন্তানাদি উপযুক্ত শিক্ষা পাবে।
সমাজের স্বাস্থ্য যদি এতটা উন্নত হয়ে যায় যে, সব কজন যোগ্য ডাক্তারের চিকিৎসা সেবার দরকার আর করে না তাহলে কতিপয় ডাক্তারকে চিকিৎসা গবেষণা কিংবা স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের জন্য অনুসন্ধান অথবা আরো প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের উন্নতির কাজে নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি না যে এতে কোনো সন্দেহ আছে ডাক্তারদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ আগের ব্যবস্থার চেয়ে বর্তমান ব্যবস্থায় আরো সুখী হবেন। অতি সফল কতিপয় ডাক্তারের আয় যদি কিছুটা কমেও যায় তবু এর ব্যত্যয় হবে না।
অতিমাত্রায় সম্পদের লিঙ্গ কোনো মতেই কাজের উদ্দীপনা হতে পারে না। বর্তমানে অধিকাংশ লোক ধনী হওয়ার জন্য নয়, অনাহার এড়ানোর জন্য কাজ করে। একজন ডাক পিয়ন অপর ডাক-পিওনের চেয়ে বেশি ধনী হওয়ার প্রত্যাশা করে না, একজন সৈনিক কিংবা নৌসেনা দেশের সেবা করে বিরাট টাকা পয়সার মালিক হতে চায় না। সত্য যে, সমাজে কিছু লোক থাকেন যারা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে চান, এদের কাছে প্রধান লক্ষ্যই হলো আর্থিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য। কেউ সমাজের মঙ্গল করেন, কেউ অমঙ্গল, কেউ কেউ করেন তৈরি কিংবা গ্রহণ করেন ব্যবহার্য উদ্ভাবন, কেউ কেউ শেয়ার বাজার স্বীয় সুবিধার জন্য কাজে লাগান কিংবা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলেন। কিন্তু প্রধানত তাদের অভিপ্রায় হলো সাফল্য অর্জন। আর সাফল্যের প্রতীক হলো টাকা। যদি অন্য কোনো আকারে সাফল্য লাভ সম্ভব হতো যেমন সম্মান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ লাভ করে, তবু তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত উৎসাহ কাজ করত এবং বর্তমানে যা করছে তা না করে সমাজের সুবিধার জন্য কাজ করতেন। সাফল্যের বাসনা নয়, শুধু সম্পদের জন্যই সম্পদের লিপ্সা, সমাজের জন্য কোনো কাজে লাগে না, এটা অতিরিক্ত আহার কিংবা পানীয় গ্রহণের চেয়েও বেশি কিছু নয়। অতএব যে সমাজ ব্যবস্থায় এই বাসনা প্রকাশের পথ নেই সেই সমাজব্যবস্থা ততটা খারাপ নয়। অপরপক্ষে যে সমাজব্যবস্থা নিরাপত্তাহীনতা দূর করেছে যে সমাজ আধুনিক জীবনধারার বাজে ভাবাগেব অনেকটাই দূর করবে।
৪. বেকার ধনী
মজুরশ্রেণির মধ্যে বেকারত্ব দেখা দিলে যে অকল্যাণ হয় তা সাধারণভাবে স্বীকৃত। নিজেদের ভোগান্তি হয়, সমাজের জন্য তার শ্রম কাজে লাগানো গেল না এটা একটা ক্ষতির দিক, এবং অনেককাল কর্মহীন থাকার ফলে তার মনোবল নষ্ট হয়ে যায়, এগুলো এতই পরিচিত বিষয় যে এ নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার করে না।
কিন্তু বেকার ধনীরা ভিন্ন ধরনের অকল্যাণ। জগৎ অলস ব্যক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ। বিশেষ করে নারীশ্রেণি, যারা সামান্যই শিক্ষা লাভ করেছে, এদের টাকাপয়সার প্রাচুর্য, ফলে এরা বিরাট আত্মবিশ্বাসের অধিকারী। যদিও এদের প্রকৃত কৃষ্টি থাকার ঘটনা বিরল, অথচ এরাই শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই শিল্পকলা বাজে ধরনের না হলে তাদের আনন্দ লাভের সম্ভাবনা কমই থাকে। তাদের অব্যবহার্যতা তাদের অবাস্তব ভাবাবেগের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে তারা সতেজ আন্তরিকতা অপছন্দ করে এবং কৃষ্টির উপর অবাঞ্ছনীয় প্রভাব খাটায়। বিশেষত আমেরিকায় যে তোক টাকা উপার্জন করে সে নিজেই উক্ত টাকা ব্যয়ের জন্য ব্যস্ত থাকে; কৃষ্টি প্রধানত পরিচালিত হয়। মহিলাদের দ্বারা, যাদের মর্যাদার প্রতি একমাত্র দাবি এই যে, তাদের স্বামীদের আয়ত্তে রয়েছে ধনী হওয়ার কৌশল। অনেকে মনে করেন সমাজতন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদ শিল্পকলার অনেক বেশি অনুকূলে, তবে আমি মনে করি এরা শুধু স্মরণ করেন অতীত জামানার অভিজাততন্ত্র এবং চলতিকালের ধনীকতন্ত্র ভুলে থাকেন।
অলস ধনীর অস্তিত্ব আরো কিছু দুর্ভাগ্যজনক ফলাফলের জন্ম দেয়। যদিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানাগুলোতে আধুনিক ঝোঁক হলো ছোট ছোট অনেক নয়, গুটিকয় বৃহৎ উদ্যোগের দিকে, তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, লন্ডনের অপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র দোকানগুলো। যে সব এলাকায় ধনী মহিলারা কেনাকাটা করেন সেখানে অসংখ্য টুপির দোকান রয়েছে, সাধারণত এই দোকানগুলোর মালিক। রাশিয়ান কাউন্টেসরা। প্রত্যেকেই দাবি করেন তাদের টুপিগুলো অন্যান্য দোকনের টুপির চেয়ে সুন্দর। এদের খদ্দেররা এক দোকান থেকে অপর দোকনে ছোটাছুটি করে, কয়েক মিনিটের কেনাকাটার কাজে ব্যয়িত হয় কয়েক ঘণ্টা। দোকানগুলোর শ্রমিকের সময় যেমন অপচয়িত হয় তেমনি খরিদ্দারের। আরো একটা অকল্যাণ এই হয় যে, কিছু সংখ্যক লোকের জীবিকা কোনো কাজে লাগে না। অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের খরচ করার ক্ষমতা থাকার দরুন তারা বিরাট সংখ্যায় পরান্নভোজী পোষে। এরা নিজেরা সম্পদ থেকে যত দূরেই অবস্থান করুন না কেন, তবু ভয় পায় অলস ধনী না থাকলে তাদের পণ্য বিক্রি হতো না এবং তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যেত।