আধুনিক বৃহদায়তন কারখানা ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের ঈপ্সা দ্বারা পরিচালিত হতে দেয়ার ফলশ্রুতি এই সব বিশৃঙ্খলা ও স্থানচ্যুতির ঘটনা।
পুঁজিবাদী শাসনে, কোন নির্দিষ্ট সামগ্রী কোন নির্দিষ্ট কারখানা উৎপাদন করবে তা নির্ণয়ের খরচ কারখানার মালিককে বহন করতে হয়, সম্প্রদায় করে না। একটা উদাহরণ সহযোগে পার্থক্যটা বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক জনৈক ভদ্রলোককে, ধরুন তার নাম মিঃ হেনরি ফোর্ড-এমন কম খরচে গাড়ি তৈরির উপায় উদ্ভাবন করেছেন যে অপর কারো পক্ষে প্রতিযোগিতায় নামা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে ফল দাঁড়ায় এই যে গাড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত বাকি সকল কারখানা দেউলে হয়ে পড়ে। নতুন সস্তা গাড়ি তৈরির সম্প্রদায়ের খরচে পৌঁছার জন্য আপনাকে মিঃ ফোর্ডকে যে পরিমাণ খরচ করতে হয় তার সঙ্গে সমানুপাতে যোগ করতে হবে বর্তমানে অকেজো অপরের মালিকানাধীন সকল কারখানা, তৎসঙ্গে যোগ করতে হবে পূর্বে অপরের কারখানায় কাজ করেছেন কিন্তু বর্তমানে বেকার কর্মী এবং ব্যবস্থাপকদের লালন পালন ও শিক্ষার খরচ। (কেউ কেউ ফোর্ডের কারখানায় কাজ নেবে। কিন্তু সম্ভবত সবাই নেবে না। কারণ নতুন পদ্ধতিতে খরচ আরো কম পড়ে সুতরাং অতিরিক্ত শ্রমিকদের দরকার করে না)। সম্প্রদায়ের আরো কিছু ক্ষেত্রে খরচের দরকার করবে-যেমন শ্রমবিরোধ, ধর্মঘট, দাঙ্গা, বাড়তি পুলিশ, বিচার ও কারাবাস। এইসব যখন হিসেবে ধরা হবে তখন হয়তো দেখা যাবে পুরাতন গাড়ি তৈরির চেয়ে নতুন গাড়ি তৈরি করতে গিয়ে প্রথম দিকে সম্প্রদায়ের খরচ অনেক বেশি পড়ছে। এখন ঘটনা হলো সম্প্রদায়ের খরচই নির্ধারণ করে সামাজিকভাবে কোনটা সুবিধাজনক। অপরপক্ষে ব্যক্তিমালিকানায় প্রস্তুতকারকের খরচ নির্ধারণ করে, আমাদের ব্যবস্থায়, যা ঘটে থাকে।
সমাজতন্ত্র এইসব সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করে তা পরবর্তী পর্যায়ে আমি ব্যাখ্যা করবো।
২. অবসরের সম্ভাবনা
যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতার দরুন মানববংশের আরাম-আয়েশের মান মোটামুটি পর্যায়ে বজায় রাখার জন্য আগের চেয়ে অনেক কম কাজ করার দরকার হয়। কিছু সতর্ক লেখক মনে করেন প্রতিদিন ঘণ্টা খানেকের কাজই যথেষ্ট, কিন্তু এই হিসেবটা এশিয়া মহাদেশের জন্য হয়তো যথেষ্ট নয়। আমি একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করে অনুমান করছি, যদি সকল বয়স্ক লোক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করেন তবে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ বাস্তব সুখের জন্য যা কিছু কামনা করেন তা উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে।
বর্তমানে, যাহোক, মুনাফা লাভেচ্ছার জন্য অবসর সমানভাবে বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না; অনেকের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, অনেকে একেবারে কর্মহীন, বেকার। এর ফলাফল দাঁড়ায় এই রকম; নিয়োগকর্তার কাছে মজুরের মূল্য সে কতটা কাজ করেছে। তার উপর নির্ভরশীল, যা যতক্ষণ সাত কি, আট ঘণ্টা অতিক্রম না করছে, নিয়োগকর্তা কর্তৃক ধরে নেয়া হয় যে তা কর্মদিবসের দৈর্ঘ্যের সমানুপাতিক হতে হবে। অপরপক্ষে, মজুরও মনে করে কম সময় কাজ করে কম মজুরি পাওয়ার চেয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করে ভালো মজুরি পাওয়া অধিকতর লাভজনক। ফলে দীর্ঘ কর্মদিবস উভয় পক্ষের কাছে উপযোগী মনে হয়, ফলে যারা বেকার তারা থাকে অনাহারে অথবা তাদের জনগণের খরচে ভরণপোষণ করতে হয়।
যেহেতু বর্তমানে মানববংশের সংখ্যাগুরু অংশ ন্যায়সঙ্গত স্বাচ্ছন্দের স্তরে পৌঁছতে পারে না তাই এখন প্রয়োজনে এবং সাধারণ স্বাচ্ছন্দের জন্য যতটা উৎপাদন করা হয় সেই পরিমাণ সামগ্রী উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞতার সঙ্গে দিনে গড়ে চার ঘণ্টার কম সময় কাজ করলেই যথেষ্ট হবে। এর অর্থ হলো, কর্মরত ব্যক্তির গড় কর্মদিবস যদি আট ঘণ্টা হয় তাহলে অর্ধেক সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, অযোগ্যতা এবং অপ্রয়োজনীয় উৎপাদনের জন্য না হলেও। প্রথমে অযোগ্যতার ব্যাপারটা ধরা যাক; আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি প্রতিযোগিতার দরুন কী রকম অপচয় হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে বিজ্ঞাপনের জন্য যাবতীয় ব্যয় এবং বিপণনের জন্য নিয়োজিত যত দক্ষ শ্রম। জাতীয়তাবাদ আরো এক ধরনের অপচয়ের জন্য দায়ী। উদাহরণত, মার্কিনী গাড়ি নির্মাতারা শুল্কের কারণে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে কারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে, অথচ যুক্তরাষ্ট্রেই যদি তারা সুবৃহৎ কারখানায় সব কটা গাড়ি নির্মাণ করত তাহলে স্পষ্টতই প্রচুর শ্রম বেঁচে যেত। তাছাড়া সমরাস্ত্র নির্মাণে অপচয় হয়, সামরিক প্রশিক্ষণে অপচয় হয়। যেখানে সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক সেখানে তো গোটা পুরুষ জনসংখ্যা জড়িত হয়ে পড়ে। তবে এইসব অপচয় এবং আরো নানা ধরনের অপচয় এবং ধনবানের বিলাসিতার ফলে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি আজ কর্মে নিয়োজিত। তবে যতদিন চলতি ব্যবস্থা চালু থাকবে অপচয় নিবারণের প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু মজুর শ্রেণির দুরবস্থা এখনকার চেয়েও খারাপ করবে।
৩. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
দুনিয়ার বর্তমানে যা অবস্থা তাতে শুধু বহুসংখ্যক লোকই নিঃস্ব নয়, সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিঃস্ব নয় তারাও সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে এই ভয়তাড়িত যে তারা যে কোনো মুহূর্তে নিঃস্ব হতে পারেন। মজুরশ্রেণি সব সময় বেকার হওয়ার বিপদ দেখে; বেতনভোগীরা জানেন যে তাদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, কিংবা কোম্পানি কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পারে ব্যবসায়ী শ্রেণি, যারা ধনী হিসেবে খ্যাত, জানেন যে তাদের সমস্ত টাকা বিনষ্ট হওয়া অসম্ভব নয়। পেশাজীবীরা কঠিন সংগ্রামের ভেতর আছেন। পুত্র-কন্যাদের শিক্ষার জন্য বিরাট আত্মত্যাগ স্বীকার করার পর তারা দেখতে পাচ্ছেন তারা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন সে দক্ষতার জন্য আগে যে চাকুরি ছিল এখন তা নেই। তারা যদি আইনজীবী হন, তবে তারা দেখতে পান জনগণের আদালতে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই, যদিও গুরুতর অন্যায় প্রতিকারহীন থেকে যাচ্ছে তারা ডাক্তার হলে দেখতে পান তাদের পূর্বেকার বেশ লাভজনক বিষাদাক্রান্ত রোগীরা আর অসুস্থ হওয়ার সাহস করছেন না; যদিও প্রকৃত রোগভোগীদের অতি-প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ছাড়াই চলতে হচ্ছে। দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত নারী-পুরুষ দোকানের গোমস্তার কাজ করছেন, এতে হয়তো তারা নিঃসম্বল হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছেন, কিন্তু পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আগে উক্ত কাজগুলো যারা করতেন। নি পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ের সকল শ্রেণির অর্থনৈতিক ভীতি পুরুষ মানুষের দিনের ভাবনা ও রাতের স্বপ্ন শাসন করে। ফলে তার কাজ স্নায়ু খুঁড়ে খায়, তার কাছে অবসর প্রফুল্লকর লাগে না। আমি মনে করি সদাপ্রস্তুত এই সন্ত্রাসই পাগলাটে মেজাজের প্রধান কারণ, যা সভ্য দুনিয়ায় বিরাট অংশে বিস্তার লাভ করেছে।