বস্তুত এটা আধুনিক উৎপাদনের জটিল বৈশিষ্ট্যের ফল। আমি যদি সেকেলে গ্রাম্য মুচি হই এবং প্রতিবেশীরা আমার কাছে তাদের জুতো নিয়ে আসে সংস্কার বা মেরামতের জন্য, তাহলে আমি জানবো যে আমার শ্রমের চাহিদা আছে; কিন্তু আমি যদি বড় ধরনের জুতো প্রস্তুতকারক হই, দামি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি, তাহলে আমাকে অনুমান করতে হবে কত জোড়া জুতো আমি বিক্রি করতে পারবো। এবং আমি সহজেই ভুল অনুমান করে বসতে পারি। আর অপর একজনের উন্নততর যন্ত্রপাতি থাকতে পারে এবং সে সস্তায় অধিক সংখ্যক জুতো বিক্রি করতে পারে; কিংবা আগের ক্রেতারা দরিদ্র হয়ে যেতে পারেন এবং তারা শিখে নিতে পারেন জুতো কত বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, কিংবা ফ্যাশনও বদলে যেতে পারে এবং জনগণের চাহিদা এমন ধরনের জুতোর জন্য হতে পারে যে ধরনের জুতো আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। এর কোনো একটি ঘটলে শুধু আমার মুনাফা লাভ বন্ধ হবে না। আমার যন্ত্রপাতি নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকবে এবং আমার কারখানায় নিয়োজিত কর্মীরা হয়ে পড়বে বেকার। আমার যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য যে শ্রম নিয়োগ করা হয়েছিল তা প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং ঐ শ্রম এতটা অপচয়িত হয়েছে যে, এর সঙ্গে সাগরে বালু নিক্ষেপের তুলনা চলতে পারে। যে লোকদের বেকারে পরিণত করা হলো তারা মানুষের প্রয়োজনে লাগার মতো আর কিছু সৃষ্টি করতে পারছে না এবং ঐ সম্প্রদায় এতটা দীন-দরিদ্র হয়ে পড়ে যে অতঃপর এদের পিছনে ব্যয় করা হয় শুধু তাদের অনাহার থেকে রক্ষার জন্য। লোকগুলো মজুরির পরিবর্তে বেকার ভাতার উপর নির্ভরশীল বলে আগের চেয়ে অনেক কম খরচ করে, এতে উৎপাদক শ্রেণিতে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারণ এখন আর লোকগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ে সমর্থ নয়। সুতরাং আমি যে এত জোড়া জুতো বিক্রি করে মুনাফা লাভ করতে পারবো মনে করে গোড়াতেই যে ভুল হিসেব করেছিলাম তা ক্রমান্বয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চাহিদার হ্রাস। নিজের সম্পর্কে বলা যায়, দামি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যাপারে আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আমার সমস্ত পুঁজি ও আর্থিক সামর্থ নিঃশেষ করেছি। ফলে হঠাৎ করে জুতো তৈরির ব্যবসা ছেড়ে সমৃদ্ধতর শিল্পে নিয়োজিত হওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
কিংবা আরো ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যবসার কথা ধরা যাক : জাহাজ নির্মাণ। যুদ্ধ চলাকালে, কিছুকালের জন্য যুদ্ধান্তেও, জাহাজের প্রচুর চাহিদা ছিল। যেহেতু কেউ জানতেন না যে যুদ্ধ কতদিন চলবে কিংবা ইউ-বোট কতটা কার্যকরভাবে সফল হবে, তাই অভূতপূর্ব সংখ্যক জাহাজ নির্মাণের জন্য খুবই ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে জাহাজের ঘাটতি পূরণ করা হয় এবং জাহাজের প্রয়োজনীয়তা সামুদ্রিক বাণিজ্য হ্রাসের ফলে হঠাৎ করে কমে যায়। প্রায় সকল জাহাজ নির্মাণ কারখানা অব্যবহার্য হয়ে পড়ে এবং কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বৃহত্তর অংশ বেকারে পরিণত হয়। এটা বলা যায় না যে তাদের এই দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়া উচিত ছিল, যেহেতু সরকারই চেয়েছে তারা যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ তৈরি করুক। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগপ্রথার অধীনে যারা নিঃস্ব হলো তাদের প্রতি সরকার স্বীকৃত কোনো দায়িত্ব নেই। এতে দরিদ্র সম্প্রসারিত হওয়া অনিবার্য। ঐ সময় ইস্পাতের চাহিদা কম ছিল। সুতরাং লৌহ এবং ইস্পাত শিল্প মার খায়। অস্ট্রেলীয় এবং আর্জেন্টাইন মাংসের চাহিদাও কম ছিল, কারণ বেকারত্বের জন্য ডাল-ভাত খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ফলে মাংসের বদলে অস্ট্রেলিয়া এবং আর্জেন্টিনা যেসব সামগ্রী নিয়েছে তার চাহিদা হ্রাস পায়। এবং এই ব্যাপারটা অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে।
বর্তমান কালে মুনাফা লাভেচ্ছার ব্যর্থতার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, আর সেটা হলো অপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কোনো পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা চলে, দামও কম থাকে। কিন্তু মাঝারি পরিমাণে উৎপাদন করলে দাম কম রাখা যায় না। তাহলে সেক্ষেত্রে উৎপাদনের মিতব্যয়ী উপায় হবে সারা জগতে প্রত্যেক পণ্যের জন্য একটি কারখানা থাকা। কিন্তু অবস্থাটা যেহেতু একবার নয় ক্রমে-ক্রমে সৃষ্টি হয়েছে, অতএব বাস্তবে রয়ে গেছে প্রত্যেক পণ্যের জন্য অনেকগুলো কারখানা। প্রত্যেকেই জানেন তার কারখানাটিই যদি জগতের একমাত্র কারখানা হতো তবে সেখান থেকে সবার জন্য সরবরাহ সম্ভব হতো, মুনাফাও হতো বড় রকমের। কিন্তু এখন অবস্থা যা, একাধিক প্রতিযোগী, কেউ পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না, ফলে কারো মুনাফার নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থাটাই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। যেহেতু মুনাফা লাভের একমাত্র সম্ভাবনা থেকে যায় একটা বিরাট বাজার একান্ত নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর। ইতোমধ্যে দুর্বলতার প্রতিযোগীরা হয়ে পড়ে দেউলিয়া, এদের কারখানা যত বড় হয় বন্ধ হয়ে যাবার পর স্থানচ্যুতি ঘটে তত বিরাট আকারে। প্রতিযোগিতার দরুন এত অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা হয় যে বিক্রি থেকে কোনো মুনাফা থাকে না। কিন্তু সরবরাহ হয় হ্রাস অথবা মন্থর, কারণ যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে নির্দিষ্ট কয়েক বছরের জন্য ক্ষতি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা উৎপাদন একেবারে বন্ধ করার চেয়ে কম বিপর্যয়কর।