উক্ত সংজ্ঞার অর্থনৈতিক অংশ ব্যাপারে আরো কিছু বলা দরকার; ব্যক্তিগত উদ্যোগের কোনো কোনো রূপ কারো কারো আছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হবে, কেউ কেউ বিপরীত মত পোষণ করবেন। কোনো উদ্যোগী ব্যক্তিকে কি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া একখণ্ড জমির উপর কাঠের গুদাম নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে? হা, হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ব্যক্তি বিশেষকে নিউইয়র্ক শহরে স্কাইস্ক্রাপার নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে। অনুরূপভাবে এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে একটি শিলিং ধার দিতে পারেন। কিন্তু একজন অর্থের যোগানদার কোনো কোম্পানি কিংবা বিদেশি সরকারকে দশ মিলিয়ন পাউন্ড ধার দিতে পারেন না। ব্যাপারটা পরিমাণের এবং সহজেই তা মিটিয়ে ফেলা যায়, যেহেতু বড় ধরনের লেন-দেনের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনগত নিয়ম-কানুন মেনে চলার দরকার আছে, কিন্তু ছোটোখাটো ব্যাপারে নয়। যেখানে নিয়ম-কানুন মেনে চলা অপরিহার্য, সেখানে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয়। আর একটা উদাহরণ নেয়া যাক, অর্থনৈতিক অর্থে অলংকার পুঁজি নয়, কারণ অলংকার উৎপাদনের মাধ্যম নয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি হিরক থেকে থাকে তবে সে তা বিক্রি করে কোম্পানির শেয়ার বা অংশীদারিত্ব ক্রয় করতে পারে। সমাজতন্ত্রের অধীনেও সে হিরকের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সে তা বিক্রি করে শেয়ার ক্রয় করতে পারবে না। কারণ বাজারে শেয়ার নামে কোনো বস্তু থাকবে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করার দরকার নেই। দরকার শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা। এতে যেহেতু কেউ মুনাফা লাভ করতে পারবে না, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাবে, থাকবে শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে লাগে এমন কিছু সামগ্রী। অন্যের উপর প্রয়োগযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে থাকা চলবে না। অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে যে সুবিধাগুলো আশা করা যাবে (অবশ্য ধরে নিতে হবে ধ্বংসকারী বৈপ্লবিক যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে) তা হবে বিভিন্ন ধরনের এবং তা কোনো ক্রমেই শুধু মজুর শ্রেণির জন্য হবে না। আমি একেবারেই নিশ্চিত নই এই সব সুবিধা বা এর যে কোনোটি দীর্ঘ জটিল শ্রেণিদ্বন্দ্বের ভেতর সমাজতান্ত্রিক দলের বিজয় দ্বারা লাভ করা যাবে। শ্রেণিদ্বন্দ্ব মেজাজ রুক্ষ করবে, নির্দয় সামরিক রূপ সম্মুখে নিয়ে আসবে, অনেক বিশেষ প্রতিভার অপচয় হবে মৃত্যুতে, কারাবাসে এবং নির্বাসনে; আর বিজয়ী সরকারের মানসিকতা হবে সেনানিবাসের। সমাজতন্ত্রের যে গুণাগুণ থাকবে বলে আমি দাবি করি তা থাকার জন্যই লোকজনকে আনতে হবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে ক্ষুদ্র অসন্তুষ্ট শ্রেণিকে পরাস্ত করার জন্য। আমি নিশ্চিত যে, সমাজতান্ত্রিক প্রচারণা যদি কম ঘৃণা ও তিক্ততার সঙ্গে পলিচালনা করা যায়, আবেদনটা হিংসার দরবারে করা না হয়, করা হয় আর্থিক সংগঠনের সুস্পষ্ট প্রয়োজনের কাছে, তাহলে মানুষকে বোঝনোর কাজটা অনেক সহজ হবে। একই সঙ্গে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পাবে। প্রবর্তনার ভেতর আইনগত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমন বিষয়ের রক্ষা ব্যতিরেকে অন্য কোনো ব্যাপারে শক্তি প্রয়োগ আমি অনুমোদন করি না, কারণ (ক) এটা ব্যর্থ হওয়া সম্ভব (খ) এই সংগ্রাম হবে বিপর্যয়কর এবং ধ্বংসাত্মক এবং (গ) দুর্দম্য বিবাদের পর বিজয়ীরা তাদের সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যেতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারেন একেবারে আলাদা জাতের শাসন, সম্ভবত সামরিক উৎপীড়নমূলক স্বেচ্ছাচারতন্ত্র। সুতরাং সফল সমাজতন্ত্রের শর্ত, আমার মতে, সংখ্যাগুরুকে উক্ত মতবাদ সম্পর্কে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠা করা।
সমাজতন্ত্রের পক্ষে আমি নয়টি যুক্তি উপস্থাপন করব। যুক্তিগুলোর একটিও নতুন নয় এবং সবগুলোর গুরুত্বও সমান মনে করা যাবে না। তালিকা অনির্দিষ্টভাবে দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু আমি মনে করি এই নয়টি যুক্তি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, সমাজতন্ত্র শুধু একটি শ্রেণির স্বার্থে সৃষ্ট মতবাদ নয়।
১. মুনাফার অভিপ্রায়ের মূলোৎপাটন
পৃথক আর্থিক শ্রেণি হিসেবে মুনাফা শিল্প বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে কেবল স্পষ্ট হয়। এর বীজাণু দৃশ্যমান হয় রবিনসন ক্রুসো এবং তার ম্যান ফ্রাইডের সম্পর্কের মধ্যে। ধরা যাক শরৎকালে রবিনসন ক্রুসো বন্দুকের সাহায্যে তার দ্বীপের সমগ্র খাদ্য সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। তাহলে সে এমন অবস্থায় আছে যে, সে এখন ফ্রাইডেকে দিয়ে পরবর্তী বছরের ফসল সংগ্রহের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগাতে পারবে। তবে কথা থাকবে যে ফ্রাইডের জীবন বাঁচিয়ে রাখা হবে এবং উদ্বৃত্ত শস্য নিয়োগকর্তার গোলায় উঠবে। এই চুক্তিবলে রবিনসন ক্রুসো যা পাবে তা তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি ও সুদ হিসেবে গণ্য করা চলে। তার পুঁজি হলো কতকগুলো যন্ত্রপাতি এবং তার অধিকারে সংরক্ষিত খাদ্য। কিন্তু মুনাফা, সভ্য দেশগুলোতে, এর চেয়েও অধিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঘটে। উদাহরণত একজন সুতা প্রস্তুতকারক তার নিজের এবং পরিবারের জন্য শুধু সুতা উৎপাদন করে না। আর সুতাই তার একমাত্র দরকারি সামগ্রী নয়, তৈরি সুতার একটা বড় অংশ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাকে বিক্রি করতে হয়। আবার সুতা তৈরির আগে তাকে অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করতে হয়। তুলা, যন্ত্রপাতি, শ্রম, বিদ্যুৎ। এই সব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তিনি যা ব্যয় করেন এবং তৈরি সামগ্রী বিক্রি করে যা লাভ করেন সেই ব্যবধানটা তার মুনাফা হিসেবে থাকে। কিন্তু তিনি যদি কারখানা নিজেই পরিচালনা করেন তাহলে একজন ব্যবস্থাপক রাখলে তাকে যে মাইনে দিতে হতো সেই পরিমাণটা বাদ দিয়ে ধরতে হবে; অর্থাৎ কল্পিত ব্যবস্থাপকের মজুরি বাদ দিয়ে পুরো আয়টা প্রস্তুতকারকের মুনাফা হবে। বড় বড় ব্যবসায়, যেখানে অংশীদারগণ ব্যবস্থাপনায় শ্রম দেন না, তারা যা লাভ করেন, সেটা হলো উদ্যোগের ফলে আহরিত মুনাফা। যাদের বিনিয়োগ করার মতো টাকা রয়েছে তারা মুনাফার আশায় প্রলুব্ধ হন। এই মুনাফা প্রত্যাশাই নতুন কি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং কোন উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা হবে তার নির্ধারক অভীপ্সা হিসেবে কাজ করে। বর্তমান ব্যবস্থার সমর্থকগণ মনে করেন মুনাফার প্রত্যাশাই সাময়িকভাবে সঠিক সামগ্রী সঠিক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব করে তুলবে। পূর্বে একটা সীমা পর্যন্ত এই ধারণার সত্যতা ছিল, কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম।