যন্ত্রের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা জন্ম দিয়েছে, যাকে আমরা বলতে পারি, ম্যানিপুলেটরদের ফ্যালাসি। এতে ব্যক্তি ও সমাজকে নিষ্প্রাণ বস্তু গণ্য করা হয়, আর ম্যানিপুলেটরদের গণ্য করা হয় স্বর্গীয় সত্তা হিসেবে। মানুষ চিকিৎসায় পরিবর্তিত হয় এবং চিকিৎসক চিকিৎসার ক্রিয়াফল হিসেবে নিজেও বদলে যান। কাজেই সামাজিক গতিবিদ্যা অত্যন্ত দুরূহ বিজ্ঞান, একনায়ককে বোঝার জন্য এই বিজ্ঞান যতটা জানা প্রয়োজন আমরা তার চেয়ে কম জানি। সাধারণ মানিপুলেটরের কাছে, রুগীর স্বাভাবিক বৃদ্ধির অনুভূতি কৃশ হয়ে পড়ে; ফল কিন্তু তার আশানুরূপ হয় না, অর্থাৎ রুগী পূর্ব পরিকল্পিত প্যাটার্নে নিষ্ক্রিয়ভাবে মিশে যায় না বরং বৃদ্ধি হয় রুগ্নতা ও বিকৃতি এবং যে প্যাটার্ন জন্ম নেয় তা হাস্যকর ও বিকট। গণতন্ত্র এবং ধৈর্যের পক্ষে চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি হলো, স্বাধীন বৃদ্ধি, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং অ-প্রশিক্ষিত স্বাভাবিক জীবনযাপন আবশ্যিক, মানুষকে যদি বিকট দৈত্যে পরিণত হতে না হয়। সে যাই হোক, আমি যেমন বিশ্বাস করি, কম্যুনিস্ট এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য, তেমনি এই বোধটাও দুঃখজনক যে, ঐ দুটিকে একমাত্র বিকল্প মনে করা হয়, এবং গণতন্ত্রকে মনে করা হয় সেকেলে। যদি লোকেরা সে রকমই মনে করে তাহলে তারাও তাই হবে; অন্যরকম ভাবলে হবে না।
০৭. সমাজতন্ত্র কেন দরকার
বর্তমান কালে সমাজতন্ত্রীদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ কার্ল মার্কসের শিষ্য, যার কাছ থেকে তারা এই বিশ্বাসটা গ্রহণ করেছেন যে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য একমাত্র সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তি হলো উৎপাদনের উপায়ের অধিকারীদের প্রতি অধিকারচ্যুত সর্বহারার অনুভূত ক্রোধ। অনিবার্য প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যারা সর্বহারা নন, গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সমাজতন্ত্রকে ঠেকাতেই হবে এবং যখন তারা শুনতে পায় যে তাদের ঘোষিত শত্রুরা শ্রেণিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় থাকাকালেই নিজেরা যুদ্ধ সূচনার প্রবর্তনা অনুভব করেন। ফ্যাসিজম কম্যুনিজমের প্রত্যুত্তর মাত্র এবং কড়া প্রত্যুত্তরই বলতে হবে। যতদিন মার্কসীয় পরিভাষায় সমাজতন্ত্রের প্রচার করা হবে ততদিন এর বিরুদ্ধাচারণও হবে শক্তিশালী এবং উন্নত পশ্চিম বিশ্বে দিন দিন এর সাফল্য আরো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ধনীরা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতই, কিন্তু সে বিরোধিতা হতো কম তীব্র ও কম ব্যাপক।
নিজের সম্পর্কে বলতে পারি, অত্যন্ত আগ্রহী মার্কসবাদীর মতোই আমি যদিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রকে সর্বহারার প্রতিহিংসার বাণী গণ্য করি না। এমনকি, প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপায়ও মনে করি না। প্রাথমিকভাবে আমি সমাজতন্ত্রকে সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনার তাগিদে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সন্ধি করে চলার উপায় মনে করি। এই সমাজতন্ত্র মানুষের সুখ বাড়াবে তবে শুধু সর্বহারার নয়, মানববংশের একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশীবাদে, সবার। হিংসোন্মত্ত বিপ্লব ভিন্ন এর বাস্তবায়ন যদি বর্তমানে সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রধানত এর হিংসাব্রত প্রবক্তাদের জন্যই তা হচ্ছে না। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি সুস্থ সমর্থন দ্বারা এর প্রতি বিরোধিতা নমনীয় করা যাবে, এবং আসন্ন পরিবর্তন কম বিপর্যয়কর করে তোলা সম্ভবপর হবে।
সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। এই সংজ্ঞায় অবশ্যই দুটি অংশ থাকতে হবে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক অংশ থাকবে প্রকৃত অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। অন্তর্ভুক্ত হবে ন্যূনপক্ষে ভূমি ও খনিজসামগ্রী, পুঁজি, ব্যাংকিং ক্রেডিট এবং বৈদেশিক বাণিজ্য। রাজনৈতিক অংশ হবে প্রকৃত রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক। স্বয়ং মার্ক্স এবং ১৯১৮ সালের আগের সকল সমাজতন্ত্রী কোনো প্রশ্ন না তুলে সমাজতন্ত্রের এই সংজ্ঞার সঙ্গে সম্মত হতেন, কিন্তু বলশেভিক দল কর্তৃক রুশ গণপরিষদ বিলুপ্তির পর থেকে একটা ভিন্ন মতবাদ জন্মলাভ করেছে। এই মতবাদ অনুসারে, বিপ্লবের মাধ্যমে যখন কোনো সমাজতন্ত্রী সরকার সাফল্য অর্জন করেছে তখন এর অনড় সমর্থকদেরই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে। অবশ্য স্বীকার করতে হবে গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পরই পরাজিতদের সব সময় ভোটাধিকার প্রদান সম্ভব হয় না, কিন্তু অনুরূপ অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। যে সমাজতন্ত্রী সরকার সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মসূচি কার্যকরি করেছে, গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভব করে তোলার জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয় সমর্থন নিশ্চিত করার আগে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয় যদি আমরা একটা চরম উদাহরণ স্মরণ করি। প্রাচ্যদেশীয় একজন স্বৈরশাসক ডিক্রি জারি করতে পারেন যে, তার রাজ্যের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের তিনি একক মালিক হবেন, কিন্তু এতে সমাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা হবে না। কঙ্গোয় দ্বিতীয় লিওপোন্ড-এর শাসন অনুকরণযোগ্য মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। জনপ্রিয় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আশা করার কী যুক্তি থাকে যে রাষ্ট্র স্বীয় সমৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কোনো কাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাবে। ফলে শোষণ শুধু নবরূপ লাভ করবে। অতএব সমাজতান্ত্রিক শাসনের সংজ্ঞার অংশ হিসেবে গণতন্ত্রকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।