ফ্যাসিবাদ সফল হলে এসবই ঘটবে। তবে এই তন্ত্র স্থায়ীভাবে সফল হবে না। কারণ ফ্যাসিবাদের পক্ষে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। নাৎসিদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ভারিশিল্প, বিশেষ করে ইস্পাত এবং রসায়নশিল্প। ভারিশিল্প জাতিগতভাবে সংগঠিত হলে আজকের দিনে যুদ্ধ সূচনায় সর্বাধিক প্রভাব খাটায়। প্রত্যেক সভ্য দেশের সরকার যদি ভারি শিল্পের সেবাদাস হিসেবে কাজ করে, বর্তমানে তা ভালো মতোই হতে দেখা যাচ্ছে-তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধ এড়ানো যাবে না। ফ্যাসিবাদের প্রত্যেক বিজয়ে যুদ্ধ নিকটে চলে আসে; আর যুদ্ধ যখন আসবে তখন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে হয়।
অবাধ বাণিজ্যনীতি, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজমের মতো ফ্যাসিবাদের কোনো সুশৃঙ্খল নীতিমালা নেই। মূলত এটি একটি আবেগতাড়িত প্রতিবাদ, অংশত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই সদস্যদের (যেমন ক্ষুদ্র দোকানদার) যারা আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত, এই ক্ষতির কারণ বিশৃঙ্খল শিল্পপতিগণ, যাদের ক্ষমতার লোভ নিজেদের শক্তিশালী মনে করাকে বাতিকে পরিণত করেছে। ফ্যাসিবাদ যুক্তিবিবর্জিত, এই কারণে যে এই তন্ত্র সমর্থকদের অভিলাষ পূরণ করতে পারে না। তাছাড়া ফ্যাসিবাদের কোনো দর্শন নেই। শুধু একটা মনঃসমীক্ষণ রয়েছে। এই তন্ত্র সফল হলে ফল দাঁড়াত সর্বগ্রাসী দুর্ভোগ। কিন্তু এই তন্ত্র যুদ্ধ সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে দীর্ঘ সময়ের জন্য সফল হবে না।
আমি মনে করি না, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ফ্যাসিবাদ গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এই দেশ দুটিতে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের ঐতিহ্য এতটা প্রবল যে তা এটা অনুমোদন করবে না। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে জনগণের ব্যাপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এবং রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার হারাতেও সে ইচ্ছে করবে না। সাধারণ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাদের কাছে খেলাধুলার (যেমন ডার্বি) মতো ঘটনা, অতএব এসব না থাকলে জীবন নিরানন্দ হয়ে পড়বে। ফ্রান্স সম্পর্কে এত সুনিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স যদি ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করে তাহলে আমি অবাক মানবো। যুদ্ধের সময়ে সাময়িকভাবে ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করতে পারে, তবে সেটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হবে।
কিছু কিছু আপত্তি আছে-আমার কাছে এই আপত্তিগুলো তর্কাতীত, এবং কম্যুনিজম এবং ফ্যাসিজম উভয় তন্ত্রের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে খাটে। উভয় তন্ত্রে একটা সংখ্যালঘু শ্রেণি পূর্বকল্পিত নক্সা অনুসারে জনগণকে বলপূর্বক ছাঁচে ঢেলে তৈরি করতে চায়। মানুষ মেশিন তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদানকে যে মূল্য দেয় ফ্যাসিবাদে জনগণের মূল্যও তদনুরূপ। প্রক্রিয়ার ভেতর উপাদানে অনেক পরিবর্তন আসে। কিন্তু যে পরিবর্তন ঘটে লক্ষ্য অনুসারে, অন্তর্নিহিত কোনো উন্নয়নের সূত্রে নয়। যেখানে প্রাণীকুল নিয়ে কথা, বিশেষত মানুষের ব্যাপারে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত ফল দেয়, ভিন্ন ফল হতে পারে শুধু বাধ্য করলে কিংবা জোর জবরদস্তির দরুন। জ্বণতত্ত্ববিদগণ দুই মাথা-ওয়ালা প্রাণী জন্ম দিতে পারে কিংবা এমন প্রাণী যার নাক এমন জায়গায় গজিয়েছে যেখানে পায়ের আঙুল থাকার কথা। কিন্তু এই দানবিকতা জীবনের জন্য খুব সুখকর নয়। অনুরূপভাবে ফ্যাসিস্ট এবং কমুনিস্টদের মনে সমাজের একটা সমগ্র চিত্র থাকার ফলে ব্যক্তিসত্তাকে দুমড়ে মুচড়ে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে চায়। যাদের ছাঁচের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব হয় না তাদের হত্যা করা হয় কিংবা পাঠিয়ে দেয়া হয় বন্দীশালায়। আমি মনে করি না যে, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, যা ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে অস্বীকার করে, নৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য, এবং এটা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সুফল হবে। গুল্ম কেটে-ছেটে ময়ূরের আকার দেয়া যেতে পারে, এবং অনুরূপ উৎপীড়ন দ্বারা একইভাবে মানুষকে বিকৃত রূপ দেয়া যায় কিন্তু গুল্ম মোচড়ানোর সময় নিষ্ক্রিয় থাকে, অপরদিকে মানুষ, একনায়কের অভিলাষ যাই হোক না কেন, সব সময় সক্রিয় থাকে, এক ক্ষেত্রে না হলেও অপর ক্ষেত্রে। মালির কাছ থেকে শেখা কাটা-ছাঁটার জন্য কাঁচি চালানোর বিদ্যা গুল্ম বিতরণ করতে পারে না, কিন্তু বিকৃত মানব সন্তান সব সময়ই অপেক্ষাকৃত বিনয়ী ব্যক্তিকে কাঁচি চালানো শেখাতে সমর্থ। কৃত্রিমভাবে ব্যক্তিচরিত্র তৈরির প্রতিক্রিয়া হয় জন্ম দেয় নিষ্ঠুরতা কিংবা ঔদাসীন্য, সম্ভবত উভয়ই পর্যায়ক্রমে জন্মে। এবং এই ধরনের চরিত্রগুণসম্পন্ন জনগণের কাছ থেকে কোনো ভালো কাজ আশা করা যায় না।
আরেক ব্যাপার হলো, একনায়কের উপর নৈতিক ফলশ্রুতি, যে সম্পর্কে ক্যুনিস্ট ও ফ্যাসিস্ট উভয় পক্ষই যথেষ্ট বিবেচনা করেন না। ধরা যাক, মানুষ হিসেবে একনায়ক যদি অত্যল্প মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন হন তাহলে তিনি প্রথমে খুবই নির্দয় হবেন এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে কোনো প্রকার নিষ্ঠুরতা করতে পিছপা হবেন না। তাত্ত্বিক কারণে মানুষকে ভুগিয়েছেন বলে তিনি শুরুতে যদি সহানুভূতি পোষণ করেন। তাহলে তাকে কঠোর চরিত্রের অধিকারী উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে কিংবা নিজের মানবিক গুণাবলি কমিয়ে ফেলতে হবে। আর যদি তাই করেন তাহলে তিনি, যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেন নি, তার চেয়ে বেশি ধর্ষকামী হয়ে উঠবেন। উভয় ক্ষেত্রে সরকার নির্দয় ব্যক্তিদের হাতে চলে যাবে, তাদের ক্ষমতাপ্রেম নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ গড়ার অভিলাষের ছদ্মবেশ ধারণ করবে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের অনিবার্য নিয়মে একনায়কতন্ত্রের প্রাথমিক লক্ষ্যের মধ্যে যা কিছু ভালো ছিল (থেকে থাকলে) তা ক্রমে ক্রমে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এবং একনায়কের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন লক্ষ্য।