৮. মাকর্স এবং ক্যুনিজমে এতটা ঘৃণা রয়েছে যে, কম্যুনিস্টদের দিয়ে আশা করা যায় না যে, বিজয়ী হবার পর তারা ঈর্ষাপরায়ণতার স্থান রাখবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে নিষ্পেষণের পক্ষে যুক্তি বিজয়ী পক্ষের বেলায় দৃঢ়তর, বিশেষত বিজয় যদি অর্জিত হয়ে থাকে হিংস্র ও সন্দিগ্ধ যুদ্ধের ফলে। এই ধরনের যুদ্ধের পর বিজয়ী দলের সুস্থ পুনর্গঠনের মেজাজ থাকবে বলে মনে হয় না। মাকর্সবাদীরা ভুলে যান যে যুদ্ধের নিজস্ব মনস্তত্ত্ব রয়েছে, যা ভয় থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে এবং মূল বিবাদের কারণ থেকে তা স্বতন্ত্র।
কম্যুনিজম ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই বলে যে মনে করা হয় তা সুনিশ্চিতভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে খাটে না। সম্ভবত ইতালি এবং জার্মানির ক্ষেত্রেও নয়। ইংল্যান্ডে এক সময় ক্রোমওয়েলের অধীনে ফ্যাসিবাদ ছিল। ফ্রান্সে ছিল নেপোলিয়নের অধীনে, এর কোনোটিই পরবর্তীকালে গণতন্ত্র আসতে প্রতিবন্ধক হতে পারে নি। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নে রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিপক্ক জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ দিক নির্দেশক হতে পারে না।
ফ্যাসিবাদের প্রতি আপত্তি ক্যুনিজমের প্রতি আপত্তির চেয়ে সরল এবং এক হিসেবে আপত্তিগুলো আরো মৌলিক। সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্টদের লক্ষ্যের সঙ্গে আমি এক মত; আমি অমত পোষণ করি তারা যে উপায় অবলম্বন করতে চান সে ব্যাপারে। ফের বলি, তাদের লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের ক্ষেত্রে, তাদের উপায় ও উপেয়, উভয় ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।
ফ্যাসিবাদ একটি জটিল আন্দোলন; এর জার্মান ও ইতালীয় আকৃতির মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য কোনো দেশে যদি এর প্রসার ঘটে তবে সেখানে আরো ভিন্ন আকার নিতে পারে। তবে এর কিছু আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা না থাকলে তা আর ফ্যাসিবাদ থাকবে না। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রবিরোধী, জাতীয়বাদী, পুঁজিবাদী, এবং এই তন্ত্রের আবেদন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই অংশের প্রতি যারা আধুনিক উন্নয়নে ভোগান্তির শিকারে পরিণত হয়েছে এবং আশঙ্কা করে যে সমাজতন্ত্র কিংবা ক্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ভোগান্তি আরো বাড়বে। ক্যুনিজম ও গণতন্ত্রবিরোধী, তবে তা একটা সময়ের জন্য, অন্তত যতক্ষণ তাদের তাত্ত্বিক ঘোষণা প্রকৃত নীতি হিসেবে গ্রহণ করা চলবে, উপরন্তু ক্যুনিজমের লক্ষ্য হলো মজুরের সেবা করা, আর এই মজুররাই উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগুরু অংশ। কম্যুনিস্টরা চান সমগ্র জনগোষ্ঠী মজুর দ্বারা গঠিত হোক। ফ্যাসিবাদ আরো মৌলিক অর্থে গণতন্ত্রবিরোধী। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে এরা বৃহত্তম সংখ্যার মহত্তম মঙ্গল নীতি গ্রহণ করে না। এরা কতিপয় ব্যক্তি, জাতি এবং শ্রেণিকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে নির্বাচন করে এবং এই নির্বাচিতদেরকেই শুধু বিবেচনায় আনে। অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ঐ পছন্দ করা ব্যক্তিদের সেবার কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হয়।
ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা লাভের জন্য সংগ্রামকালে জনসংখ্যার একটা অংশের কাছে আবেদন রাখতে হয়। জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিবাদ মূল কর্মসূচির যা কিছু জাতীয়তাবাদ বিরোধী তা বর্জন করে সমাজতন্ত্রের ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে। সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারণা ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা সমগ্র জগতের উপকারের জন্য না হয়ে, একটি দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থে কাজ করবে এবং এই স্বার্থ উদ্ধার করা হয় যত না দক্ষতা বাড়িয়ে তার চেয়ে বেশি মজুর ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অ-জনপ্রিয় অংশের উপর নিষ্পেষণের মাত্রা চড়িয়ে। যে শ্রেণিগুলো ফ্যাসিবাদের বদান্যতার পরিধির বাইরে অবস্থান করে তারা খুব বেশি হলে স্বপরিচালিত জেলখানায় বসবাসের সুযোগ পায়; ফ্যাসিবাদ এর চেয়ে বেশি কিছু করার ইচ্ছেও পোষণ করে না।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তিই এখানে যে এই তন্ত্রে সমগ্র মানবতার একটি নির্বাচিত অংশকেই শুধু গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। সন্দেহ নেই, সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা বাস্তব ক্ষেত্রে অনুরূপ নির্বাচন করে আসছেন; কিন্তু খ্রিষ্টধর্ম তত্ত্বগতভাবে সবসময়ই মানবাত্মাকে স্বনির্ভর সত্ত্বা হিসেবে স্বীকার করেছে; এই সত্তা অপরকে গৌরবান্বিত করার হাতিয়ার নয়। আধুনিক গণতন্ত্র খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক আদর্শ থেকে শক্তি লাভ করেছে এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ধনী ও শক্তিমানদের স্বার্থে একান্তভাবে মনোযোগ দেয়া থেকে ভিন্নমুখী করার ব্যাপারে অবদান রাখে। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ প্রাচীন প্যাগানবাদের জঘন্যতম আদর্শে প্রত্যাবর্তন।
ফ্যাসিবাদ সফল হলে পুঁজিবাদের অকল্যাণকর দিক প্রতিকারের জন্য কিছুই করবে; বরং পুঁজিবাদকে জঘন্য পর্যায়ে উন্নীত করবে। শ্রমিকদের বলপূর্বক কায়িকশ্রমে নিয়োগ করা হবে। তাদের জুটবে শুধু খোরাকি। এই শ্রমিকদের কোনো প্রকার রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না, পছন্দ করা স্থানে থাকা ও কাজের স্বাধীনতা থাকবে না এবং সম্ভবত তাদের স্থায়ী পারিবারিক জীবনও থাকবে না; বস্তুতপক্ষে তারা ক্রীতদাসে পরিণত হবে। জার্মানি যেভাবে বেকার সমস্যার মোকাবিলা করে তাতে এই ব্যাপারগুলোর সূচনা হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে এটা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত পুঁজিবাদের অনিবার্য ফল এবং রুশদেশে শ্রমিকের অনুরূপ দাসত্ব অবস্থা যে-কোনো প্রকার একনায়কতন্ত্রের অনিবার্য ফসল। অতীতে দেখা গেছে, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এসেছে ক্রীতদাসপ্রথা কিংবা ভূমিদাসত্ব।