এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, আদিম গোত্রসমূহে কৃষকদের নিজের নিয়মে চলতে দিলে, তারা তাদের সামান্য উদ্বৃত্ত হাতছাড়া করত না, যে উদ্বৃত্তের উপর যোদ্ধা ও পুরোহিত শ্রেণি নির্ভর করেছে। বরং তারা হয় কম উৎপাদন করত কিংবা উদ্বৃত্ত উৎপাদন নিজেরাই ভোগ করত। প্রথমে তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে উৎপাদনে এবং উদ্বৃত্ত হস্তান্তরে বাধ্য করা হতো। যাহোক, ক্রমান্বয়ে, বোঝা গেল, তাদের এমন নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যে নীতিবলে তারা কঠোর পরিশ্রম কর্তব্য মনে করবে, যদিও তাদের শ্রমের একটা অংশ অলসদের পকেটে চলে যাবে। এই উপায়ে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমে যায়। এবং সরকারি ব্যয় হয় হ্রাস। আজকের দিনেও নিরানব্বই শতাংশ ব্রিটিশ শ্রমজীবী সত্যি আহত বোধ করবে যদি তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে রাজার আয় সাধারণ কর্মীর বেশি হওয়া উচিত হবে না। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে কর্তব্যবোধ দ্বারা ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা অপরকে প্রভুদের স্বার্থে বাঁচার জন্য বাধ্য করতেন। তাদের নিজেদের জন্য নয়। অবশ্য ক্ষমতার অধিকর্তৃকগণ এই ব্যাপারটা নিজেদের কাছেই গোপন রাখেন একটা কৃত্রিম বিশ্বাস অর্জন করে যে তাদের স্বার্থ গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। অনেক সময় ব্যাপারটা সত্যও; এথেন্সের দাস মালিকরা, উদাহরণত, তাদের অবসরের একটা অংশ ব্যয় করতেন সভ্যতায় স্থায়ী অবদান রাখার জন্য, যা ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্ভব হতো না। সভ্যতার জন্য অবকাশ অত্যন্ত দরকারি, অতীতকালে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি যে অবসর ভোগ করতে পারতেন তার কারণ জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ শ্রম দিতেন। তাদের শ্রম মূল্যবান ছিল এ জন্য নয় যে কাজ কল্যাণকর, কল্যাণকর হলো অবসর। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সভ্যতার কোনো ক্ষতি না করেও অবসর ন্যায্যভাবে বণ্টন সম্ভবপর হবে।
বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিশ্চিত করতে যে শ্রম দরকার আধুনিক প্রযুক্তি তা ব্যাপকহারে হ্রাস সম্ভব করে তুলেছে। যুদ্ধের সময় এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। তখন সামরিক বাহিনীর সকল লোক, যুদ্ধোপকরণ তৈরির কাজে নিয়োজিত সকল নর-নারী, গোয়েন্দাগিরি, যুদ্ধে অপপ্রচার এবং যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোর সকল নর-নারীকে উৎপাদন-খাত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এতদসত্ত্বেও, মিত্রশক্তির অদক্ষ শ্রমজীবীদের বাস্তব অবস্থার স্তর যুদ্ধের আগের চেয়ে কিংবা পরের চেয়েও উচ্চতর ছিল। এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য আর্থিক ব্যবস্থা দ্বারা গোপন রাখা হয়; দেনা করে দেখানো হয় যেন ভবিষ্যৎ বর্তমান সময়কে পুষ্টি যোগাচ্ছে। তবু তা হওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ রুটি না-থাকলে একজন লোক কী-করে রুটি খেতে পারে। যুদ্ধ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদন দ্বারা, আধুনিক জগতের শ্রম শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশের সাহায্যেই আধুনিক জনসংখ্যাকে বেশ স্বাচ্ছন্দের ভেতর রাখা সম্ভব। যদি যুদ্ধের পর বৈজ্ঞানিক সংগঠন বা উপায়, যা সৃষ্টি করা হয়েছিল জনশক্তিকে মুক্ত করে যুদ্ধে যোগদান এবং যুদ্ধোপকরণ তৈরির জন্য, রক্ষা করা হতো এবং কর্মদিবসের স্থিতিকাল কমিয়ে চার ঘণ্টা করা হতো, তাহলে সকলের অবস্থাই ভালো না হয়ে পারত না। এটা না-করে পুরাতন বিশৃঙ্খলা পুনর্বাসিত করা হয়। যাদের কাজের চাহিদা রয়েছে তাদের কাজের স্থিতিকাল দেয়া হয় বাড়িয়ে। বাকিদের করা হয় বেকার ও নিরন্ন। কারণ? কাজ হচ্ছে কর্তব্য এবং একজন মানুষকে কাজের অনুপাতে পারিশ্রমিক দেয়া হবে না, তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হবে কাজ নামক পুণ্যের অনুপাতে।
এই নৈতিকতা দাস রাষ্ট্রের, এবং তা এমন পরিস্থিতিতে আরোপ করা হয়েছে যে পরিস্থিতির একেবারেই উদ্ভব ঘটেনি। অবাক হবার কিছু নেই যে, এতে ফলাফল দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়কর। একটা উদাহরণ ধরা যাক। ধরুন, এক বিশেষ মুহূর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক পিন প্রস্তুতে নিয়োজিত রয়েছে। দুনিয়ায় যত পিনের দরকার তত পিন তারা প্রস্তুত করে। ধরুন তারা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে। এখন কোনো ব্যক্তি এমন উপায় উদ্ভাবন করেছে যে উপায়ে উক্ত সংখ্যক লোক আগের চেয়ে দ্বিগুণ পিন উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু দুনিয়ায় দ্বিগুণ সংখ্যক পিনের দরকার নেই; এবং পিনের দাম ইতোমধ্যেই এত সস্তা হয়েছে যে ঐ বস্তুর দাম আরো কমে গেলেও বাড়তি পিন কেউ ক্রয় করবে না। যুক্তিনির্ভর জগতে, পিন প্রস্তুতের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই আট ঘণ্টার বদলে চার ঘণ্টা কাজ করবে এবং অন্য সবকিছু আগের মতোই চলবে। কিন্তু বাস্তব জগতে এই ভাবনাকে অনৈতিক গণ্য করা হয়। যদি লোকগুলো আট ঘণ্টাই কাজ করে তাহলে খুব বেশি পিন তৈরি হবে। অনেক নিয়োগকর্তা হবেন দেউলে, পূর্বে পিন তৈরিতে নিয়োজিত কর্মী সংখ্যার অর্ধেক হবে বেকার। এতে কর্মী সংখ্যার অর্ধেক থাকবে সম্পূর্ণ অলস, অপরপক্ষে বাকি অর্ধেক হবে কর্মভারপীড়িত। এই উপায়ে অনিবার্য অবসর সার্বিক দুরবস্থার কারণ হবে। অথচ হওয়া উচিত ছিল সার্বজনীন সুখের উৎস। এই অসুস্থকর অবস্থার কথা ভাবা যায়?
আসল ব্যাপার হলো, দরিদ্র লোকেরা অবসর ভোগ করবেন এই ধারণায় ধনীরা সর্বদাই আহত বোধ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন কর্মীর সাধারণ কর্মদিবসের পরিধি ছিল পনেরো ঘণ্টা; শিশুদেরও প্রায় সমান সময় কাজ করতে হয়েছে, অন্তত দিনে বারো ঘণ্টা কাজ তাদের করতে হয়েছেই। অপরের ব্যাপারে অযথা নাক গলানো যাদের অভ্যাস তারা যখন ইঙ্গিত প্রদান করেন যে এত ঘণ্টা কাজ খুব বেশি সময় হয়ে যায়, তখন তাদের বলা হয় যে কাজ বয়স্কদের সুরাপান থেকে বিরত রাখে, আর শিশুদের বিরত রাখা যায় অপকর্ম থেকে। আমার ছেলেবেলায় শাহরিক শ্রমজীবীরা ভোট প্রদানের অধিকার লাভের পর আইন দ্বারা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য সরকারি ছুটি প্রতিষ্ঠা করা হয়, এতে উচ্চবিত্তের লোকেরা হয় দারুণ ক্ষুব্ধ। মনে পড়ে, জনৈক প্রবীণ ডাচেস-কে বলতে শুনেছি; দরিদ্র লোকেরা ছুটি দিয়ে কী করতে চায়? তারা কাজ করতে বাধ্য। জনগণ আজকাল খোলাখুলি কথা কম বলেন, তবে ঐ মেজাজ রয়েই গেছে, আর এটা পরিণত হয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক বিভ্রান্তির উৎস।