যখন আমি একজন সাম্যবাদী (Communist) সম্পর্কে বলি, আমি এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝাই যিনি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মতবাদগুলো কবুল করেছেন। এক হিসেবে প্রথম যুগের খ্রিস্টানরা কম্যুনিস্ট ছিলেন, মধ্যযুগের অনেকানেক গোষ্ঠীই অনুরূপ ছিলেন। কিন্তু ঐ হিসেবটা আজ আর চলে না। আমি কেন কম্যুনিস্ট নই তার কারণগুলো পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করছিঃ
১. আমি মার্কস-এর দর্শন সমর্থন করতে অপারগ। Materialism and Emperio-Criticism আরো কম সমর্থন করি। আমি বস্তুবাদী নই। যদিও ভাববাদ থেকে আমার অবস্থান ততধিক দূরে। আমি বিশ্বাস করি না যে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের জন্য কোন প্রকার দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বান্দ্বিকতায় বিশ্বাস মার্কস গ্রহণ করেছিলেন হেগেল থেকে, বাদ দিয়েছিলেন এর যৌক্তিক ভিত্তি অর্থাৎ ভাবের প্রাথমিকতা। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে মানবিক বিকাশ পরবর্তী স্তরে এক হিসেবে হবে প্রগতি; এই বিশ্বাসের পক্ষে আমি কোনো যুক্তি দেখতে পাই না।
২. মার্কস-এর মূল্যতত্ত্ব আমি গ্রহণ করতে পারি না, আরো পারি না উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের তিনি যে আকৃতি দিয়েছেন তা। কোনো পণ্যের বিনিময় মূল্য ঐ পণ্য উৎপাদনে যে শ্রম লেগেছে তার সমানুপাতিক, এই তত্ত্ব, যা মার্কস রিকার্ডো থেকে গ্রহণ করেছিলেন, তা রিকার্ডোর খাজনা-তত্ত্ব দ্বারাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আর অনেক আগেই ঐ তত্ত্ব অ-মার্কসীয় অর্থনীতিকরা বর্জন করেছেন। উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যা অন্যত্র মার্কস নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। মার্কসের অর্থশাস্ত্রে যৌক্তিক সমগ্রতা নেই, বরং তা গঠিত হয়েছে পুরাতন মতবাদ গ্রহণ ও বর্জনের উপর। এই গ্রহণ ও বর্জনের কাজটা চলেছে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করার অনুকূলে।
৩. কোনো একজন মানুষকে অভ্রান্ত গণ্য করা বিপজ্জনক ব্যাপার। এর ফল দাঁড়ায় অবশ্যম্ভাবীরূপে অতি-সরলীকরণ। বাইবেলের আক্ষরিক অনুপ্রেরণার ঐতিহ্য মানুষকে পবিত্র গ্রন্থ খোঁজার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে। কিন্তু কর্তৃপূজা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।
৪. সাম্যবাদ গণতান্ত্রিক নয়। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র আসলে সংখ্যালঘুর একনায়কতন্ত্র। এই সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শাসনকার্য শাসকশ্রেণির স্বার্থেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রভাবিত হলেই শুধু ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই শিক্ষা শুধু ইতিহাসের নয়, মার্কসেরও। সাম্যবাদী রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণির ক্ষমতা এমনকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী শ্রেণির চেয়ে বেশি। এই শ্রেণি যতদিন সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারবে ততদিন ক্ষমতা খাঁটিয়ে এমন সুবিধা আদায় করতে পারে যা পুঁজিবাদীদের ক্ষমতার সমান ক্ষতিকর। ক্যুনিজম সর্বদাই সাধারণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে মনে করা বোকামিপূর্ণ ভাববাদ ছাড়া কিছু নয়, এবং এটা মার্কসীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের বিরোধী।
৫. ফ্যাসিবাদ ছাড়া অন্য যে কোনো তন্ত্রের চেয়ে কম্যুনিজম মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে অনেক বেশি। বিশেষত বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পূর্ণ একীকরণ অত্যাচারের এমন ভয়ানক যন্ত্র তৈরি করে যাতে কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ঘটার ছিদ্রপথ থাকে না। এমন ব্যবস্থায় প্রগতি অনতিবিলম্বে অসম্ভব হয়ে পড়বে, কারণ আমলাদের চরিত্রই এই যে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া অন্য যে কোনো প্রকার পরিবর্তনে তারা বাধা প্রদান করে থাকে। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনা সম্ভব হয় এ জন্য যে আপতিকভাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তি বেঁচে থাকতে সমর্থ হন। কেপলার জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে জীবন ধারণ করেছেন, ডারউইন টিকে ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ লাভ করে। মার্কস পেয়েছেন, এঙ্গেলস কর্তৃক মানচেস্টারের সর্বহারাদের শোষণের অংশ। অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বেঁচে না থাকার অনুরূপ সুযোগ সাম্যবাদী শাসনের অধীনে সম্ভব নয়।
৬. সমকালীন মার্ক্সীয় সাম্যবাদী চিন্তায় মেধার চেয়ে কায়িক শ্রমকে বেশি গৌরবময় করে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে মেধাকর্মীদের শত্রুতে পরিণত করা হচ্ছে, অথচ এরা হয়তো সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পেতেন এবং এই মেধাকর্মীদের সহায়তা ব্যতিরেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংগঠন কমই সম্ভব।
৭. শ্রেণি-যুদ্ধের পক্ষে প্রচারের দরুন ঐ যুদ্ধ এমন সময়ে বেঁধে যেতে পারে যখন পরস্পরবিরোধী পক্ষের শক্তি কম বেশি সমান, কিংবা এমন সময়েও সংগঠিত হতে পারে যখন পাল্লাটা পুঁজিবাদীদের পক্ষেই ভারী। যদি পুঁজিবাদী পক্ষের শক্তি অধিকতর ভারী হয় তাহলে ফল দাঁড়াবে প্রতিক্রিয়ার যুগ। যদি উভয় পক্ষের শক্তি মোটামুটি সমান হয় তাহলে যুদ্ধের আধুনিক পদ্ধতির জন্য, সভ্যতার ধ্বংসসাধন সম্ভব, সঙ্গে-সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী উভয় পক্ষের বিলুপ্তি ঘটবে। আমি মনে করি, যেখানে গণতন্ত্র চালু আছে, সেখানে সমাজতন্ত্রীদের উচিত জনগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করা, শুধু বিরোধী পক্ষের অবৈধ বলপ্রয়োগ রোধের জন্যই শক্তি প্রয়োগ করা উচিত। এই পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রীদের শক্তির পাল্লা এতটা ভারী হবে যে পরিণামী যুদ্ধ হবে খুব সংক্ষিপ্ত, যুদ্ধের তীব্রতাও এতটা হবে না যে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।