জাতীয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানকে দেখবে জাতীয় গর্ব বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে। শুধু পৃথিবীর ইতিহাস নয়, সভ্যতার ইতিহাসও এই দৃষ্টিকোণ থেকে শেখাতে হবে। উদ্ভাবক শুধুমাত্র উদ্ভাবক হিসেবে আবির্ভূত হবেন না, তার উপস্থাপন হবে স্বদেশবাসী হিসেবে। কোনো বৃহৎ কীর্তির প্রতি সম্ভ্রমের সঙ্গে গৌরব যুক্ত করতে হবে, কারণ ঐ ভাগ্যবান কৃতিপুরুষ আমাদের জাতির সদস্য। আমরা অবশ্যই জার্মান ইতিহাসের মহৎ নামের ভিড়ের ভেতর থেকে মহত্তমদের বের করে আনবো এবং তাদের স্থাপন করবো যুবকদের সামনে, এবং এটা করতে হবে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক উপায়ে যাতে তারা জাতীয় অনুভূতির অটল স্তম্ভ হতে পারে।
সত্যানুসন্ধান হিসেবে বিজ্ঞানের ধারণা হিটলারের কাছ থেকে এতটা দূরীভূত হয়েছে যে, তিনি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তি বিস্তার করেন না। আমরা যেমন জানি, আপেক্ষিকতা-সূত্র মন্দ বিবেচিত হয়েছে, কারণ উক্ত সূত্রের আবিষ্কর্তা একজন ইহুদি। ইনকুইজিশন গ্যালিলিও-র মতবাদ বাতিল করে দেয় এই বিবেচনায় যে, উক্ত মতবাদ অসত্য; হিটলার কিন্তু কোনো মতবাদ গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন রাজনৈতিক কারণে, তাঁর কাছে সত্য বা মিথ্যা কোনো ব্যাপার নয়। হতভাগা উইলিয়াম জেমস, যিনি এই দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভাবক, অবশ্যই আতংকগ্রস্ত হতেন দেখে যে তার দৃষ্টিভঙ্গির কী অপব্যবহার শুরু হয়েছে; কিন্তু যখন একবার বস্তুগত সত্যের ধারণা বর্জিত হলো, এটা পরিষ্কার যে আমি কি বিশ্বাস করবো? এই প্রশ্নের মীমাংসা তখন করতে হবে- আমি যেমন ১৯০৭ সালে লিখেছিলাম, বল প্রয়োগ এবং বৃহৎ সৈন্যদলের মধ্যস্থতা দ্বারা, ধর্মতত্ত্ব কিংবা বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে নয়। যে রাষ্ট্রের নীতির ভিত্তি যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সে রাষ্ট্র অবশ্যই দেখতে পাবে যে তাদের সঙ্গে শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধ বাধেনি। গির্জাগুলোর সঙ্গেও বিরোধ দেখা দিয়েছে; অবশ্য যেখানে খ্রিষ্টধম খাঁটি অবস্থায় টিকে আছে।
যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অনেক সমর্থ এবং উদ্যোগী পুরুষ ক্ষমতাপ্রীতি চরিতার্থ করার পথ খুঁজে পায় না, ফলে হয়ে পড়ে নাশকতামূলক চরিত্রের। অতীতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো অধিক মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে দিয়েছে, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা অধিক সংখ্যক লোককে দিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ভেবে দেখুন এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা, যারা ঘুমায় শহরতলিতে, কাজ করে বড়-বড় নগরে। এদের ট্রেনে লন্ডন শহরে আসতে হয়, পথের দুপাশে দেখতে পায় বিরাট এলাকা জুড়ে ছোট-ছোট বাগান বাড়ি। এই বাড়িগুলোর পরিবারসমূহ শ্রমজীবীদের সঙ্গে কোনো প্রকার সংহতি বোধ করে না; পরিবারগুলোর লোকেরা স্থানীয় ব্যাপারেও অংশগ্রহণ করে না। কারণ নিয়োগকর্তার আদেশ পালন করতেই এদের দিন ফুরিয়ে যায়। তাদের উদ্যোগশীলতা চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় হলো সপ্তাহান্তে বাড়ির পেছনে বাগান পরিচর্যা। রাজনৈতিকভাবে শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য কিছু করা হলে তারা ঈর্ষা বোধ করে এবং যদিও নিজেরা যে দরিদ্র সেটা অনুভব করে, কিন্তু নাক উঁচু ভাবটা বজায় রাখার জন্য সমাজতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের পদ্ধতি গ্রহণ করে না। তাদের শহরতলী হয়তো প্রাচীন কালের বিখ্যাত নগরগুলোর মতো জনবহুল, কিন্তু তাদের সামাজিক জীবন ক্লান্তিকর, এবং সামাজিক জীবনে উৎসাহী হওয়ার মতো সময়ও নেই। এ ধরনের লোকের কাছে যদি অসন্তোষ প্রকাশের মতো যথেষ্ট শক্তি থাকে তাহলে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন তাদের কাছে মুক্তিদাতা বলে প্রতিভাত হয়।
রাজনীতিতে যুক্তির অবক্ষয় দুটি উপাদানের সৃষ্টি; একদিকে যেমন বিভিন্ন শ্রেণি ও চরিত্রের ব্যক্তি রয়েছে যাদের চলতি দুনিয়া কোনো সুযোগ দেয় না, এরা সমাজতন্ত্রেও কোনো ভরসা দেখে না, কারণ তারা শ্রমজীবী নয়; অপরদিকে, অনেক সমর্থ এবং শক্তিশালী লোক রয়েছেন যাদের স্বার্থ বৃহত্তর সমাজের বিরোধী, ফলে তারা কেবলমাত্র নানা ধরনের ভুল ভাবাবেগের পক্ষে কাজ করে। ক্যুনিজম-বিরোধিতা, বৈদেশিক অস্ত্রভাণ্ডারের ভীতি এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার প্রতি ঘৃণা, ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জুজু। এতে আমি বোঝাচ্ছি যে, তারা বাস্তব সমস্যার বুদ্ধিমান বিবেচনা বাদ দিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। এই পৃথিবীর যে দুটি জিনিসের সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো সমাজতন্ত্র ও শান্তি, কিন্তু এই দুটি জিনিসই আমাদের সময়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের স্বার্থের বিরোধী। এমন পদক্ষেপ নেয়া খুব কঠিন নয়, যাতে এটা জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের কাছে স্বার্থবিরোধী মনে হবে এবং কাজটি করার সহজ উপায় হলো গণভাবাবেগ সৃষ্টি করা। সমাজতন্ত্র ও শান্তির জন্য বিপদ যত বড় হবে সরকারসমূহ ততই প্রজাদের প্রলোভন দেখিয়ে বিপথগামী করবে; জনগণের চলিত আর্থিক কষ্ট যত বড় হবে, দুর্ভোগপীড়িত জনগণের বুদ্ধিগত মিতাচার হবে ততই বিনষ্ট, ক্রমাত্মক আলেয়ার পেছনে ছোটায় হবে অতিরিক্ত অভ্যস্ত।
জাতীয়তাবাদের জ্বর, যা ১৮৪৮ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, যুক্তিহীনতাতত্ত্বের একটা রূপ মাত্র। এক ও অদ্বিতীয় সর্বজনীন সত্যের ধারণা বর্জন করা হয়েছে; এখন সত্যের নানা ভেদ, ইংরেজ সত্য, ফরাসি সত্য, জার্মান সত্য, মন্টেনেগ্রান সত্য, রাজশাসিত মোনোকো রাষ্ট্রের জন্যও একটা সত্য রয়েছে। অনুরূপভাবে শ্রমজীবীর জন্য রয়েছে একটা সত্য, পুঁজিবাদীদের জন্য ভিন্ন সত্য। এইসব বিভিন্ন সত্যের মধ্যে, যৌক্তিক প্রক্রিয়া যদি হতাশ হয়, তাহলে একমাত্র সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যুদ্ধ, এবং অপপ্রচারকারী উন্মাদগ্রস্ততার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মধ্যে বিরাজিত গভীর বিরোধ, যা আমাদের জগৎকে সংক্রমিত করেছে, সমাধা না করা পর্যন্ত মানুষ যুক্তিশীলভাবে চিন্তার অভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করবে, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। অসুবিধাটা এখানে যে, যত দীর্ঘকাল যুক্তিহীনতা বিরাজ করবে, আমাদের অসুবিধাগুলোর সমাধানে পৌঁছানো ততই দৈবাধীন হয়ে পড়বে। কারণ যুক্তি নৈর্ব্যক্তিক বলে সর্বজনীন সহযোগিতা সম্ভব করে তোলে। যুক্তিহীনতা যেহেতু গোপন আসক্তির প্রতিনিধিত্বকারী, ফলে বিবাদ হয়ে পড়ে অনিবার্য। এই কারণেই যুক্তিশীলতা, সত্যের সর্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক মানের কাছে আবেদনের অর্থে, মানব-বংশের উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, শুধু সেই সময়ের জন্যই নয় যখন সহজে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, বরং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই সব মন্দ-ভাগ্যের সময়ের জন্য যখন একে এক শ্রেণির পুরুষের অসার স্বপ্ন হিসেবে ঘৃণা ও বাতিল করা হয়।
০৬. সিলা ও ক্যারিবডিস অথবা সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ
আজকের দিনে অনেকেই বলে থাকেন সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদই হলো রাজনীতি ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প, এবং যিনি একটাকে সমর্থন করেন না তিনি প্রকারান্তরে অপরটিকে সমর্থন করেন। আমি এই উভয় তন্ত্রের বিরোধী, বিকল্প হিসেবে এই দুটির কোনো একটিকেই আমি সমর্থন করতে অপারগ। আর আমি যদি ষোড়শ শতকের লোক হতাম তবে প্রটেস্টান্ট কিংবা ক্যাথলিক হতাম। প্রথমে আমি সাম্যবাদ সম্পর্কে আমার আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ করব। অতঃপর ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে। তারপর দেখবো এই দুটি তন্ত্রের মধ্যে কোথায় মেলে।