১৯২০ সালের জগতের সঙ্গে ১৮২০ সালের জগতের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই যে কয়েকটি গোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; বড়-বড় শিল্পপতি, শ্রমজীবী, নারী, ধর্মদ্বেষী এবং ইহুদিদের। (এখানে ধর্মদ্বেষী বলতে আমি তাদের বুঝিয়েছি যাদের ধর্ম তাদের দেশের সরকারি ধর্ম নয়) পারস্পরিকভাবে, এই শ্রেণিগুলো ক্ষমতা হারিয়েছেন: রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, পাদরি, নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণি এবং নারীর তুলনায় পুরুষরা। বড়-বড় শিল্পপতিরা, যদিও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিকতর শক্তিশালী, সমাজতন্ত্রের হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেছেন, বিশেষ করে এদের মধ্যে মস্কোর ভীতি কাজ করছে। যাদের স্বার্থ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত, যেমন সমরনায়ক, নৌসেনাপতি, পাইলট, অস্ত্রনির্মাতা প্রতিষ্ঠান, তাদের অবস্থা এই রকম: বর্তমানে তারা খুব শক্তিশালী কিন্তু বলশেভিক এবং শান্তিবাদী নামক বিনাশক দলের ভয়ে ভীত। এরা ইতোমধ্যেই রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, ক্ষুদ্র দোকানদার, যারা মেজাজের কারণে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাবিরোধী, যারা আক্ষেপ করেন নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের দিনগুলোর জন্য, ইত্যাদি শ্রেণিকে পরাজিত করেছে; এরা সুনিশ্চিতভাবে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়েছেন বলেই মনে হয়; অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ, ভাবা হয়, আধুনিক জগতে তাদের জন্য কোনো স্থান রাখেনি। স্বাভাবিকভাবেই তারা অসন্তুষ্ট হন, সামগ্রিকভাবে এদের সংখ্যাও অগণন। তাদের মানসিক প্রয়োজনের জন্য নিৎশের দর্শন মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপযোগী করে তোলা হয়, এবং অত্যন্ত চতুরভাবে শিল্পপতি ও সমরবিদগণ এই অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে পরাজিত গোষ্ঠীগুলোকে একটা দলে রূপান্তরিত করে, যারা শিল্প ও যুদ্ধ বাদে সবকিছুর প্রতি মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়া সমর্থন করবে। শিল্প ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে গোটা প্রযুক্তি হবে আধুনিক, ক্ষমতার অংশীদারিত্বের বেলায় নয়, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যাবে না, কারণ শান্তিই বর্তমান শিল্পপতিদের কাছে সমাজতন্ত্রীদের বিপজ্জনক করে তুলেছে।
কার্যত নাৎসি দর্শনে অযৌক্তিক উপাদানগুলো ঢুকেছে, রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, সেই গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আদায়ের প্রয়োজনে যাদের জন্য আর কোনো লক্ষ্য নেই, সুস্থ উপাদানগুলো স্থান পেয়েছে শিল্পপতি ও সমরবিদদের জন্য। পূর্বোক্ত উপাদান অযৌক্তিক, কারণ ক্ষুদ্র দোকানদারগণ প্রত্যাশা বাস্তবায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না, এবং হতাশা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের আজগুবি বিশ্বাসে আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর নেই; অপরদিকে, ফ্যাসিবাদের সাহায্যে শিল্পপতি এবং সমরবিদগণ তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন, অন্য কোনো উপায়ে ইচ্ছাপূরণের সম্ভাবনা নেই বললে চলে। সভ্যতার ধ্বংসসাধন করেই কেবল তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, এই ঘটনা থেকে তারা অযৌক্তিক হন না, খাড়া শয়তানে পরিণত হন। এরা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিগত উপাদান; নৈতিক দিক দিয়ে হীনতম; বাকিরা গৌরব, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের স্বপ্নে চমকিত হয়ে তাদের গুরুতর স্বার্থের প্রতি হয়ে পড়েছে অন্ধ, এবং আবেগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে নিজেদের এমন লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে যা তাদের লক্ষ্য হতে পারে না। এটাই হচ্ছে নাৎসিরাজ্যের মনস্তাত্ত্বিক রোগনিরূপণ বিজ্ঞান।
শিল্পপতি এবং সমরবিদ, যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক, তারা সুস্থ মনের অধিকারী বলেছি, কিন্তু তারা কেবলমাত্র তুলনামূলকভাবে সুস্থ। দাইজেন (Thyssen) বিশ্বাস করেন যে, তিনি একই সঙ্গে সমাজতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা এবং তার বাজার বিরাট আকারে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম। ১৯১৪ সালের তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক মনে করার অধিক কোনো কারণ দেখি না। জার্মান আত্মবিশ্বাস এবং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি বিপজ্জনক মাত্রায় উন্নীত করা তার জন্য খুবই দরকারি, এবং এর ফলাফল যে অসফল যুদ্ধ তা এক রকম অনিবার্য। এমনকি বড় ধরনের প্রাথমিক কিছু সাফল্যও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারবে না; বিশ বছর আগের মতো, এখন জার্মান সরকার আবার আমেরিকাকে ভুলে গেছে।
একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা, সামগ্রিকভাবে নাৎসিবিরোধী, যদিও প্রতিক্রিয়াশীলতার সমর্থক হতে পারত-আমি সংঘবদ্ধ ধর্মের কথা বলছি। যে আন্দোলনের দর্শন নাৎসিবাদে পৌঁছেছে তা এক হিসেবে প্রটেস্টান্টবাদের যৌক্তিক বিকাশ। ফিশতে ও কার্লাইলের নৈতিকতা ক্যালভিনপন্থী, এবং ম্যাৎসনি, যিনি আজীবন রোমের বিরোধিতা করেছেন, লুথারপন্থীদের মতো ব্যক্তি-বিবেকে আগাগোড়া বিশ্বাসী ছিলেন। নিৎশের ব্যক্তির মূল্যের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল, এবং তাঁর বিবেচনায় বীর কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করবেন, এটা অনুচিত। এক্ষেত্রে তিনি প্রাটেস্টান্টদের বিদ্রোহী শক্তিকে বিকশিত করেছিলেন। হয়তো প্রত্যাশা করা যেত যে প্রটেস্টান্ট গির্জাগুলো নাৎসি আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাবে, একটা পর্যায় তারা তা করেছেও। কিন্তু যে সব ব্যাপারে প্রটেস্টান্টবাদ ক্যাথলিকবাদের শরিক ছিল, দেখতে পেল নতুন দর্শন তার বিরোধী। নিৎশে ছিলেন জোরালোভাবে খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী, এবং হিউস্টন চেম্বারলেন বুঝিয়ে গেছেন যে খ্রিস্টধর্ম হলো নীচু শ্রেণির কুসংস্কার যা গড়ে উঠছে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় (Levant) সংকর জাতীয় বিশ্বনাগরিকদের মধ্যে। বিনয়-নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, বশংবদ ব্যক্তিদের অধিকার, এসব বাতিল করে দেয়া গসপেলের শিক্ষার বিরোধী; এবং এন্টিসেমিটিজম, যখন এটা একই সঙ্গে তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক, ইহুদিদের ভেতর থেকে জন্ম নেয়া ধর্মের সঙ্গে সহজে আপোস করতে পারে না। এইসব কারণে নাৎসিরাজ্য এবং খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন কঠিন, এবং এটা অসম্ভব নয় এদের মধ্যেকার পারস্পরিক বিরুদ্ধাচারণ নাৎসিদের পতন ঘটাবে। কি জার্মানি কিংবা অন্য কোথাও আধুনিক অযৌক্তিকতার সঙ্গে প্রথাগত খ্রিস্টধর্মের আরো একটা কারণে সহাবস্থান সম্ভব নয়। ইহুদি ধর্ম-দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম, সত্যের ধারণার সঙ্গে পরস্পরসূত্রে বিশ্বাসের পুণ্য গ্রহণ করে। ঐ ধারণা ও পুণ্য সৎ সংশয়ের মধ্যে বেঁচে থাকে, যেমন ভিক্টোরীয় যুগের সকল মুক্তচিন্তাবিদদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের সকল পুণ্য স্থান লাভ করেছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সংশয়বাদ এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাবে দেখা গেল সত্য আবিষ্কার নৈরাশ্যজনক। কিন্তু মিথ্যাচারের উপর জোর দেয়া লাভজনক। হিটলার নাৎসী দলের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেছেন: