এই গোষ্ঠীর মতবাদে সেই সময়ের পর শুধুমাত্র একটা নতুন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হয়েছে, উপাদানটি হলো জাতি নামক ছদ্ম-ডারউইনবাদী বিশ্বাস। (ফিশতে জার্মান শ্রেষ্ঠতা বুঝতেন ভাষাগত দিক থেকে, জৈবিক উত্তরাধিকার নয়) নিৎশে, যিনি তাঁর অনুসারীদের মতো জাতীয়তাবাদী এবং সেমাইট বিরোধী ছিলেন না, তাঁর মতবাদ কেবলমাত্র বিভিন্ন ব্যক্তির ভেতর প্রয়োগ করেন; ইচ্ছে করেছেন অযোগ্যদের সন্তান প্রজননে বাধা দিতে হবে এবং আশা করেছেন, কুকুর বিশেষজ্ঞদের পদ্ধতিতে, শ্রেষ্ঠতর। জাতির উৎপাদন, যাদের ক্ষমতা থাকবে, এবং এদের হিতসাধনের জন্যই শুধু মানবতার বাকি অংশ বেঁচে থাকবে। তবে পরবর্তী সকল লেখকই অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে সর্বপ্রকার চমৎকারিত্ব তার জাতির মধ্যে মিশে আছে। আইরিশ লেখকরা হোমর যে আইরিশ ছিলেন তা প্রমাণ করার জন্য অনেক পুস্তক লিখেছেন; ফরাসি নৃতত্ত্ববিদগণ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন কেল্ট নয়, টিউটনরাই উত্তর ইউরোপের সভ্যতার উৎস; হিউস্টন চেম্বারলেন বিস্তৃত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে দান্তে ছিলেন জার্মান এবং খ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন না। ঈঙ্গ ভারতীয়দের মধ্যে জাতিতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ সর্বজনীন ব্যাপার। এদের কাছ থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর মাধ্যমে এই সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে ইংল্যান্ডে সেমেটিক বিরোধিতা কখনো শক্তিশালী ছিল না; যদিও একজন ইংরেজ, হিউস্টন চেম্বারলেন, জার্মানিতে সেমেটিক বিরোধিতার মিথ্যা ঐতিহাসিক ভিত্তি প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করেন। তবে জার্মানিতে এটা দাপটের সঙ্গে মধ্যযুগ থেকে বজায় ছিল।
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, জাতি সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা যায় না। এটা সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায় যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে জেনেটিক মানসিক ব্যবধান থাকতে পারে; তবে এটা সুনিশ্চিত যে ব্যবধানটা কী তা আমরা এখনও জানতে পারি নি। বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে পরিবেশের প্রতিক্রিয়া বংশগতির ছাপ আড়াল করে। উপরন্তু বিভিন্ন ইউরোপীয়দের জাতিগত পার্থক্য, সাদা, হলুদ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে কম সুনির্দিষ্ট ইউরোপীয়দের মধ্যে এমন কোনো সুচিহ্নিত শারীরিক বৈশিষ্ট্য নেই যে যার সাহায্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিসমূহের সদস্যদের আলাদা করে চেনা যেতে পারে, কারণ বিভিন্ন উৎসের সংমিশ্রণের ফলাফল হলো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। মানসিক শ্রেষ্ঠতার বেলায় প্রত্যেকটি সভ্য জাতি গ্রহণযোগ্য দাবি উত্থাপন করতে পারেন, এতে প্রমাণিত হয় যে সবার দাবি সমানভাবে অসিদ্ধ। এটা সম্ভব হতে পারে যে ইহুদিরা জার্মানদের চেয়ে হীন, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সম্ভব হতে পারে জার্মানরা ইহুদিদের চেয়ে হীন। এই প্রশ্নে ছদ্ম-ডারউইনবাদী অর্থহীন কথা সূচনা করার গোটা ব্যাপারটাই বিজ্ঞানবিরোধী। ভবিষ্যতে মানুষ যাই জানতে সমর্থ হোন না কেন, বর্তমানে আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে একটি জাতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে অপর একটি জাতিকে উৎসাহিত করার ইচ্ছে বোধ করতে পারি।
ফিশতে থেকে শুরু করে গোটা আন্দোলনের পদ্ধতিটাই হলো আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়াস এবং ক্ষমতাভিলাষ। উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কতকগুলো বিশ্বাস। যে বিশ্বাসগুলোতে এমন কিছুই নেই তাদের পক্ষে যায়, কেবল বিশ্বাসগুলো একটু আত্মতৃপ্তিকর বটে। ফিশতের একটা মতবাদের দরকার ছিল যা তাকে নেপোলিয়নের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর অনুভব করতে সাহায্য করবে; কার্লাইল এবং নিৎশে কয়েকটি ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন, ফলে উক্ত দুর্বলতাগুলোর ক্ষতিপূরণ খোঁজেন কল্পনার জগতে; রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদিতার কারণ শিল্পায়নে প্রাধান্য হারানোর লজ্জা এবং আমাদের কালের হিটলারীয় পাগলামী হলো মিথ্যার মুকুট, যার সাহায্যে জার্মান অহমকে ভার্সাইর ঠাণ্ডা ঝাঁপটার বিরুদ্ধে উষ্ণ রাখা হয়। মারাত্মক আঘাতে আত্ম মর্যাদা বিক্ষত হলে কোনো মানুষই সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারেন না, এবং যারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জাতিকে অপমানিত করে তারা শুধু নিজেদেরকেই ধন্যবাদ জানাতে পারেন যদি নিজেরা উন্মাদের জাতিতে পরিণত হন।
এখানেই আমি কারণগুলো খুঁজে পাই যা অযৌক্তিক এমনকি যুক্তিবিরোধী (আমাদের বিবেচ্য) মতবাদটি ব্যাপকভাবে গ্রহণ সম্ভব করে তুলেছে। প্রায় সব সময়ই সব ধরনের মতবাদ সব ধরনের প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিগণ প্রচার করতেন, তবে যে মতবাদগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে তা অবশ্যই ঐ সময়ের পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট মেজাজের প্রতি বিশেষ আবেদন রাখে। আধুনিক যুক্তিবিযুক্তবাদীদের মতবাদগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা যেমন দেখেছি, চিন্তা ও অনুভূতি বাদ দিয়ে, ইচ্ছা-র উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ। ক্ষমতাকে গৌরবান্বিত করে তোলে। পর্যবেক্ষণমূলক এবং আরোহী পরীক্ষার পরিবর্তে পদান্বয়ী অব্যয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থাপনে বিশ্বাস। মনের এই অবস্থা, উড়োজাহাজের মতো যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ যাদের অভ্যাস এবং আরো, যারা বর্তমানে আগের চেয়ে কম ক্ষমতাবান এবং পূর্বেকার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুক্তিশীল পথ খোঁজায় অসমর্থ, তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। শিল্পায়ন ও যুদ্ধ, যান্ত্রিক ক্ষমতার অভ্যাস সূচিত করলেও, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অবস্থানের পরিবর্তন করেছে, ফলে বড় বড় গোষ্ঠীর মেজাজ হয়েছে বাস্তবিক আত্ম-জাহিরের। এবং এর পরিণামই হলো ফ্যাসিবাদ।