অবশ্য কঠিন কাজ হলো কারা পছন্দকৃত বা নির্বাচিত তা জানা। যে জগতে ফিশতের মতবাদ সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করা হবে সেই জগতের প্রত্যেকেই মনে করবেন তিনি মহৎ ব্যক্তি, এবং তিনি এমন দলে যোগ দেবেন যে দলকে তার মতামতের যথেষ্ট অনুরূপ মনে হবে এবং আরো মনে হবে যে উক্ত দল তার মতোই মহৎ। উক্ত দলীয় লোকগুলো তার জাতি হতে পারে, ফিশতের বেলায় যেমন হয়েছিল, তার শ্রেণিভুক্তও হতে পারে, সর্বহারা ক্যুনিস্টদের বেলায় যেমন; কিংবা তার পরিবার, নেপোলিয়নের বেলায় যেমন। মহত্ত্বের কোনো বস্তুগত বৈশিষ্ট্য নেই, যুদ্ধে সফল হওয়া ছাড়া; সুতরাং এই নীতির অনিবার্য ফল হলো যুদ্ধ।
জীবন সম্পর্কে কার্লাইলের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানত ফিশতে থেকে গৃহীত। একমাত্র ফিশতেই তাঁর মতামতকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন। কিন্তু কার্লাইল এর সঙ্গে আরো কিছু যোগ করেন যা তখন থেকে উক্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে; এ যুক্ত হয় এক ধরনের সমাজতন্ত্র এবং সর্বহারাদের জন্য উল্কণ্ঠা, যা প্রকৃত শিল্পবাদ ও নব্য ধনীদের অপছন্দ করে। কার্লাইল এ কাজটি এত সুন্দরভাবে করেন যে এঙ্গেলসও এতে প্রতারিত হন। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত ইংরেজ শ্রমজীবীদের উপর লিখিত পুস্তকে তিনি কালাইলের উচ্চ প্রশংসা করেন। সুতরাং আমরা অবাক হই না যে জনগণ জাতীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমাজতন্ত্রের বহিরাবরণ দেখে মুগ্ধ হন।
বস্তুত, কার্লাইলের এখনও প্রতারণা করার শক্তি আছে। তার বীর পূজা খুবই মর্যাদাকর শোনায়; তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচিত সংসদের দরকারই নেই, বরং দরকার বীর-রাজা, এবং অ-বীরোচিত নয় এমন একটা জগৎ। এটা বোঝার জন্য তা কীভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত হয় সেটা বিচার করে দেখতে হবে। কার্লাইল অতীত ও বর্তমান গ্রন্থে দ্বাদশ শতাব্দীর অ্যাবট স্যামসনকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন। একজন যদি তাকে পাত্তা না দিয়ে বরং Chronicle of Jocelin of Brakelonde পড়েন তিনি দেখতে পাবেন যে উক্ত অ্যাবট ছিলেন বিবেকহীন দাঙ্গাবাজ, যার মধ্যে মিশেছিল অত্যাচারী ভূ-স্বামী এবং বটতলার উকিলের সকল দোষ। কার্লাইলের অপরাপর বীরগণও অন্তত সমান আপত্তিকর। ক্রোমওয়েল আয়ারল্যান্ডে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানোর পর তিনি মন্তব্য করেন, আমি বলবো অলিভারের সময়েও ঈশ্বরের সুবিচারে বিশ্বাস করা হতো; কিন্তু অলিভারের সময়ে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষে কথার উন্মত্ত ফুলঝুরি ছিল না, এই পাপপূর্ণ জগতে জাঁ-জ্যাক ফিলানথ্রপি এবং সর্বজনীন গোলাপজল নিয়ে বাড়তি কথা হতো না, কেবলমাত্র পরবর্তী অবক্ষয়ী প্রজন্মে-ভালো ও মন্দ এমন নির্বিচারে মিশে সার্বিক ঝোলা-গুড়ে পরিণত হয়-বাস্তবায়িত হয় এই জগতে। তার অপরাপর বীরদের অধিকাংশ সম্পর্কে, যেমন ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট, ড. ফ্রানসিয়া, এবং গবর্নর আয়ার, একটি কথাই বলা প্রয়োজন যে, এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল একটিই, এবং তা হলো, রক্তের জন্য দুর্নিবার তৃষ্ণা।
যারা এখনও মনে করেন যে কার্লাইল কম-বেশি উদারপন্থী ছিলেন তাদের অতীত ও বর্তমান-এ গণতন্ত্রের উপর লিখিত অধ্যায়টি পড়া উচিত। এই অধ্যায়ের প্রায় গোটা অংশে উইলিয়াম দ্য কনকারের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁর সময়ে ভূমিদাসরা কি সুখী জীবনযাপন করেছেন, দিয়েছেন তার বর্ণনা। অতঃপর দিয়েছেন স্বাধীনতার সংজ্ঞা, মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা, আপনি বলবেন, সঠিক পথ বেছে নেয়া কিংবা বেছে নিতে বাধ্য করা এবং উক্ত পথে হাঁটা (পৃ. ২৬৩)। এরপর তিনি বলেন, গণতন্ত্র হলো শাসিত হওয়ার জন্য বীর খুঁজে হতাশ হওয়া এবং বীরের অভাব মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। অধ্যায়টি শেষ করা হয়েছে গয়গম্বরসুলভ গম্ভীর ভাষায় বিবৃতি দিয়ে: গণতন্ত্রের দৌড় পূর্ণ হবার পর যে সমস্যা থেকে যাবে তা হলো আপনার চেয়ে প্রকৃত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি দ্বারা শাসিত সরকার অনুসন্ধান। এই কথাগুলোতে এমন একটি শব্দ কি রয়েছে। যা হিটলার সমর্থন করতেন না?
ম্যাৎসিনির মেজাজ কার্লাইলের চেয়ে নমনীয় ছিল, বীরতন্ত্র ব্যাপারে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর আদরের ধন ছিল জাতি, মহান ব্যক্তি নয়। এবং যদিও তিনি ইতালিকে সর্বোচ্চ স্থান দিতেন, তবু আইরিশদের বাদ দিয়ে ইউরোপীয় সকল জাতির ভূমিকা স্বীকার করতেন। অবশ্য তিনি কার্লাইলের মতো কর্তব্যের স্থান সুখের উপর বলে বিশ্বাস করতেন। এমনকি এর স্থান সর্বজনীন সুখের উপর। তিনি ভাবতেন ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সঠিক বিবেক দিয়েছেন, সর্বোপরি দরকার হলো, সবাই তাঁর আন্তরিকভাবে অনুভূত নৈতিক বিধি মান্য করে চলবে। তিনি কখনো বুঝতে পারেননি যে বিভিন্ন ব্যক্তি আন্তরিকভাবেই নৈতিক বিধি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন, অথবা তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে চাইতেন যে অন্যেরা তিনি যাকে উচিত কর্তব্য মনে করবেন তাই কবুল করবেন। তিনি নৈতিকতাকে গণতন্ত্রের উপর স্থান দিয়ে বলেছেন; সংখ্যাগুরুর সাধারণ ভোটে সার্বভৌমত্ব গঠিত হয় না, যদি তা সর্বোচ্চ নৈতিকতার সুস্পষ্টভাবে বিরোধিতা করে,….. জনগণের ইচ্ছা পবিত্র, যখন জনগণ নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করে; আইন থেকে বিচ্যুত হলে বাতিল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এতে খামখেয়ালী প্রকাশ পায়। মুসোলিনিরও একই অভিমত ছিল।