যে চিন্তাসংঘ থেকে ফ্যাসিবাদ জন্ম নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা কল্যাণ অন্বেষণ করেছেন ইচ্ছার মধ্যে, অনুভূতি কিংবা প্রত্যক্ষ জ্ঞানে নয়, তারা সুখের চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি মূল্যবান মনে করেন। তাদের পক্ষপাত বলপ্রয়োগের প্রতি, যুক্তিশীলতার প্রতি নয়। তাদের কাম্য শান্তি নয়, যুদ্ধ, গণতন্ত্র নয়, অভিজাততন্ত্র, বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা নয়, অপপ্রচার। তারা প্রাচীনকালের স্পার্টায় প্রচলিত কৃচ্ছুতাসাধনকে অন্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের উপায় মনে করেন, আত্ম-শৃঙ্খলার উপায় মনে করেন না, যা পুণ্য অর্জনের অনুকূল এবং কেবল অপর জগতে সুখ নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে শেষোক্তরা জনপ্রিয় ডারুইনবাদে আপুত এবং অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামকে তারা উন্নততর প্রজাতির উৎস গণ্য করেন; তবে এই সংগ্রাম হবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, মুক্ত প্রতিযোগিতার পক্ষপাতীরা যেমন এর পক্ষে ওকালতি করে থাকেন। সুখ ও জ্ঞানকে লক্ষ্য মনে করা তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় ব্যাপার। তাদের কাছে সুখের বিকল্প হলো গৌরব, এবং জ্ঞানের বিকল্প হিসেবে ধরেন এই ব্যবহারিক দাবি যে তারা যা ইচ্ছে করেন তাই সত্য। ফিশতে, কার্লাইল এবং ম্যাসিনির কাছে এই মতবাদগুলো এখনও প্রথাগত নৈতিক ভাষার পোশাকে আবৃত; নিৎশের কাছে এগুলো প্রথমে নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে এগিয়ে যায়।
এই বিরাট বিপ্লব উদ্বোধনের জন্য ফিশতের যতটুকু কৃতিত্ব পাওয়া উচিত ছিল তিনি তা পান নি। তিনি শুরু করেন বিমূর্ত পরাবিজ্ঞানী হিসেবে, তবু পরবর্তীকালে স্বেচ্ছাচারী এবং আত্মকেন্দ্রিক মেজাজের পরিচয় দেন। তাঁর গোটা দর্শন আমি আমিই, এই অবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য:
অহম (Ego) নিজেকে স্থাপন করে এবং এই স্থাপনের ফলেই সে অহম; এটা একই সঙ্গে প্রতিনিধি ও কাজের ফলাফল, এটি সক্রিয় এবং সক্রিয়তা দ্বারা সৃষ্ট; আমি আছি বলতে কর্ম বোঝায় (Thathandlung), অহম আছে, কারণ এটি নিজেকে স্থাপন করেছে।
এই তত্ত্বানুসারে অহম অস্তিত্বশীল, কারণ অহম অস্তিত্বশীল থাকতে চায়। উপস্থিত মনে হয় যে নন-ইগোও অস্তিত্বশীল, কারণ ইগো একে অস্তিত্বশীল দেখতে চায়। তবে এভাবে সৃষ্ট নন-ইগো কখনো ইগো বহির্ভূত কিছু হতে চায় না, কারণ ইগো একে স্থাপন করা সাব্যস্ত করেছে। চতুর্দশ লুই বলতেন, Letat cest moi,১২ ফিশতে বলতেন, আমি নিজেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কান্ট এবং রোবেসপিয়য়ের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে হাইনে মন্তব্য করেছেন, আমরা জার্মানদের তুলনায় তোমরা ফরাসিরা নিস্তেজ ও নমনীয়।
এটা সত্য যে ফিশতে কিছু পরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এই আমি বলতে তিনি ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন; কিন্তু পাঠক কী-করে এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হতে পারেন।
জেনার যুদ্ধের পর-পর ফিশতেকে যখন বার্লিন থেকে পালিয়ে যেতে হলো, ভাবলেন নিজেও নন-ইগোকে খুব বেশি জোর দিয়ে নেপোলিয়নের আকারে স্থাপন করছেন। ১৮০৭ সালে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিখ্যাত জার্মান জাতির প্রতি বক্তৃতা প্রদান করেন। উক্ত বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো তিনি জাতীয়তাবাদের সমগ্র নীতিমালা উপস্থাপন করেন। এই বক্তৃতাগুলো শুরু করা হয় এই ব্যাখ্যা দিয়ে যে জার্মানরা আধুনিক জাতিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ এই জাতির শুধু বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে। (রুশ, তুর্কী, চিনা, এস্কিমোদের এবং হটেনটটদের নাম না হয় নাই উল্লেখ করি, যদিও তাদের বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে)। ফিশতে কিন্তু তাঁর ইতিহাসের বইগুলোতে তা উল্লেখ করেন নি। জার্মান ভাষায় বিশুদ্ধতা কেবল জার্মানদেরই গভীরতার সমর্থতা দিয়েছে; তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, চরিত্র থাকা এবং জার্মান হওয়া নিঃসন্দেহে একই জিনিস বোঝায়। কিন্তু যদি জার্মান চরিত্রকে বৈদেশিক কলুষতার সংক্রামক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হয়, এবং জার্মান জাতিকে যদি এককভাবে কাজে সমর্থ হতে হয়, তাহলে অবশ্যই নতুন ধরনের শিক্ষার দরকার করবে, যে শিক্ষা জার্মান জাতিকে সম্মিলিত একদেহে রূপান্তরিত করবে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা অবশ্যই এমন হবে যে তা ইচ্ছার স্বাতন্ত্র ধ্বংস করবে। তিনি আরো যোগ করেন, ইচ্ছা হলো মানুষের প্রকৃত ভিত্তি।
বহির্বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, কিছুটা একেবারে অনিবার্য হড়ে পড়লে সেটুকু মেনে নিতে হয় তার অতিরিক্ত নয়। সামরিক বাহিনীতে চাকুরি সার্বজনীন করতে হবে। সবাইকে যুদ্ধে অশগ্রহণে বাধ্য করতে হবে, বাস্তব অবস্থার উন্নয়নের জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য নয়, শাসনতন্ত্র সংরক্ষণের জন্যও নয়, বরং এই তাড়নার অধীনে করতে হবে যে-উচ্চতর দেশপ্রেমের সর্বগ্রাসী শিখা। এই দেশপ্রেম জাতিকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে মহাকালের পোশাক হিসেবে, যার জন্য মহৎ লোকেরা আনন্দের সঙ্গে আত্মোৎসর্গ করে, এবং অবজ্ঞেয় লোকেরা, যারা কেবল অপরের জন্য বেঁচে আছে, তাদেরও অনুরূপভাবে আত্মোৎসর্গ করতে হবে।
মহৎ মানুষ মানবতার লক্ষ্য, এবং অবেজ্ঞয় মানুষের নিজেদের কোনো দাবি নেই, এই মতবাদ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আধুনিক আক্রমণের প্রধান দিক। খ্রিস্টধর্ম শেখায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে এবং এই হিসেবে সকল মানুষই সমান। মানুষের অধিকার তত্ত্ব খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদের বিকাশ মাত্র। উপযোগবাদ ব্যক্তির জন্য সর্বাত্মক অধিকার স্বীকার না করলেও, একজন মানুষের সুখের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দেয়, সকল মানুষের প্রতি ততটুকুই গুরুত্ব দিয়ে থাকে; ফলে এই মতবাদের পরিণতি গণতন্ত্র, প্রাকৃতিক অধিকার-এর মতবাদ যেমন। কিন্তু ফিশতে, এক ধরনের রাজনৈতিক ক্যালভিনদের মতো, নির্দিষ্ট কিছু লোককে বেছে নেন, অন্যদের বাতিল করে দেন অবান্তর গণ্য করে।