যুক্তির উপর নির্ভরতা যেভাবে সংজ্ঞায়িত হলো, তা ব্যক্তি ও তার শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে স্বার্থ ও দৃষ্টিকোণের নির্দিষ্ট একতা বিরাজ করছে ধরে নেয়। সত্য যে, মিসেস বন্ড এই যুক্তি তাঁর পাঁতিহাসগুলোর উপর প্রয়োগ করেন, যখন তিনি চিৎকার করে বলেন, এসো এবং নিহত হও, কারণ তোমাকে দিয়ে আমার ক্রেতাদের উদর পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের কাছে যুক্তি খাটানো অকার্যকর ভাবা হয় যাদের আমরা প্রকৃতপক্ষে গ্রাস করতে ইচ্ছুক। যে ব্যক্তি মাংস ভক্ষণে বিশ্বাস করে সে এমন যুক্তিজাল বিস্তারের চেষ্টা করে না যা ভেড়ার জন্য বৈধ মনে হবে এবং নিৎশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন না যাদের তিনি এই বলে গাল দেন যে এরা অপদার্থ এবং কদর্য। মার্কসও পুঁজিবাদীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন না। এই উদাহরণগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, যুক্তির প্রতি আবেদন সহজতর হয় যখন ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে কতিপয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অষ্টাদশ শতকের বিলেতে কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণির লোক এবং তাদের বন্ধুদের মতামতের গুরুত্ব ছিল। এবং এই মতামত সব সময়ই অপরাপর অভিজাতদের কাছে যৌক্তিক আকারে উপস্থাপন করা যেত। রাজনৈতিক নির্বাচকমণ্ডলীর আকার বৃদ্ধি এবং মতামতের ভিন্নতা তীব্রতর হলে, যুক্তির প্রতি আবেদন কঠিনতর হয়ে পড়ে, কারণ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি যাত্রাবিন্দুর সংখ্যা কমে যায়, যা থেকে সম্মতি সূচিত হতে পারে। যখন অনুরূপ যাত্রাবিন্দু খুঁজে পাওয়া যায় না, লোকেরা তখন স্ব-স্ব স্বজ্ঞার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়; এবং যেহেতু বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বজ্ঞা বিভিন্ন, অতএব এগুলোর উপর নির্ভরতা পরিচালিত করে বিবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতিতে।
এদিক থেকে যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ইতিহাসের পুনরাবর্তক ঘটনা। প্রথম যুগের বৌদ্ধধর্ম ছিল যুক্তিশীল; এর পরবর্তী আকৃতি, এবং ভারতে যে হিন্দুধর্ম এর স্থান দখল করে, উভয়ই ছিল যুক্তিবর্জিত। প্রাচীন গ্রিসে অর্ফিয়ুসপন্থীরা হোমারের যুক্তিশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সক্রেটিস থেকে মারকাস অরেলিয়াস পর্যন্ত প্রাচীন কালের সকল প্রসিদ্ধ ব্যক্তি প্রধানত যুক্তিশীল ছিলেন। মারকাস অরেলিয়াসের পর এমনকি রক্ষণশীল নব্য-প্লেটোবাদীরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়। ইসলামি জগৎ বাদ দিয়ে ধরলে যুক্তির দাবি একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শিকেয় তোলা থাকে। অতঃপর স্কলাস্টিসিজম, রেনেসাঁস এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে যুক্তি ক্রমান্বয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। রুশো এবং ওয়েসলের জন্য একটা প্রতিক্রিয়া মাথাচাড়া দিয়েছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও যন্ত্রাদির বিজয়ের দরুন বেশিদূর এগোতে পারেনি। ষাটের দশকে যুক্তিতে বিশ্বাস সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল; কিন্তু তারপর থেকে এর প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় এবং এখনও হ্রাস পাচ্ছে। গ্রিক সভ্যতার সূচনা থেকে বুদ্ধিবাদ এবং বুদ্ধিবাদ বিরোধিতা পাশাপাশি বাস করেছে, এবং যখন মনে হয়েছে কোনো একটি সম্পূর্ণ প্রাধান্য লাভ করতে পারে, তখন প্রতিক্রিয়া দ্বারা, সর্বদাই বিরুদ্ধপক্ষ নতুনভাবে আসরে ফেটে পড়েছে।
যুক্তির বিরুদ্ধে আধুনিক বিদ্রোহ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে পূর্বেকার বিদ্রোহসমূহ থেকে বিভিন্ন। অর্ফিয়ুসবাদ থেকে শুরু করে, অতীতে সাধারণ লক্ষ্য ছিল মুক্তি,-এই ধারণাটা জটিল, এতে মিশে রয়েছে কল্যাণচিন্তা ও সুখ, এবং নিয়মানুসারে এটা অর্জন করা হতো কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের সময়ের যুক্তিবিরোধীদের লক্ষ্য মুক্তি নয়, ক্ষমতা। এই লক্ষ্যে তারা এমন নৈতিক কর্তব্য দাঁড় করিয়েছে যা একই সঙ্গে খ্রিষ্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম বিরোধী। এবং আধিপত্য করার বাসনা থেকে প্রয়োজনে জড়িত হয়ে পড়েছে রাজনীতির সঙ্গে। এদের লেখক তালিকায় রয়েছেন; ফিশতে, কার্লাইল, ম্যাসিনি, নিৎশে-আর এদের সমর্থনদাতারা হলেন ট্রেইটশকে, রাডিয়ার্ড কিপলিং, হিউস্টন চেম্বারলেইন এবং বার্গসে। এই আন্দোলনের বিরোধীদের মধ্যে বেন্থামপন্থীদের এবং সমাজতন্ত্রীদের একই দলের দুই শাখা গণ্য করা চলে। উভয় শাখা বিশ্বজনীন, জাতীয় সংস্কারমুক্ত, উভয় দল গণতান্ত্রিক। উভয় দলের আবেদন অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি। এদের মধ্যে তফাতটা উপায়ের ব্যাপারে, উপেয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পক্ষান্তরে এই নতুন আন্দোলন, যার পরাকাষ্ঠা (এখন পর্যন্ত) ঘটেছে হিটলারে, উপেয় ব্যাপারেও ভিন্ন, গোটা খ্রিস্টীয় সভ্যতার ঐতিহ্য থেকেও পৃথক।
রাষ্ট্রনীতিজ্ঞদের যে লক্ষ্য অন্বেষণ করা উচিত, প্রায় সকল যুক্তিবিরোধী যেমন মনে করেন, যা থেকে জন্ম নিয়েছে ফ্যাসিবাদ, তা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছেন নিৎশে। সচেতনভাবে, খ্রিস্টধর্ম এবং উপযোগবাদ-এর বিরোধিতা করে তিনি বেন্থামের মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। ঐ মতবাদের সুখ ও সর্ববৃহৎসংখ্যা কথা দুটির জন্য। মানবতা, তিনি বলেন, উপেয়-র চেয়ে অধিক উপায়-মানবতা কেবলমাত্র পরীক্ষামূলক বস্তু। তার প্রস্তাবে উপেয় হলো অসাধারণ ব্যক্তির মহত্ত্ব: লক্ষ্য হলো পর্যাপ্ত মহৎ শক্তি অর্জন যা মানুষের ভবিষ্যতের রূপ দেবে, শৃঙ্খলা আরোপ এবং কোটি কোটি আনাড়ি ও কদর্য লোক সম্পূর্ণ নির্মূল করার মাধ্যমে, তবু এই আনাড়ির উক্ত উপায়ে সৃষ্ট দুর্ভাগ্যের দৃশ্য দেখে ধ্বংসপ্রাপ্তি এড়াতে পারে, যে ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা ইতঃপূর্বে ছিল না। উপেয় সম্পর্কিত এই ধারণা, লক্ষ্য করা উচিত, স্বতঃই যুক্তিবিরোধী নয়, কারণ উপেয়-র প্রশ্ন যুক্তি দ্বারা নির্ধারণ সম্ভব নয়। এটা আমরা অপছন্দ করতে পারি, আমি নিজে পছন্দ করি না-কিন্তু আমরা এটা ভ্রমাত্মক প্রমাণ করতে পারি না, নিৎশে যেমন নির্ভুল প্রমাণ করতে পারেন না। তথাচ এর সঙ্গে যুক্তিহীনতার স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে, যেহেতু যুক্তি দাবি করে পক্ষপাতহীনতা, পক্ষান্তরে মহৎ মানুষের তন্ত্র সবসময় প্রতিজ্ঞার উপর জোর দেয়; আমি মহৎ ব্যক্তি।