কিন্তু যে মুহূর্তে যুক্তির মন্দির নির্মাণ প্রায় শেষ হবার পথে, সেই সময় একটা মাইন পোতা হয় এবং পরিশেষে গোটা অট্টালিকা বিস্ফোরিত হয়ে দূর আকাশে বেড়াতে থাকে। যে ব্যক্তি এই মাইন পুতেছিলেন তার নাম ডেভিড হিউম। তাঁর মানবের প্রকৃতি (Treatise of Human Nature) প্রকাশিত হয় ১৭৩৯ সালে, বইটির উপনাম ছিল নৈতিক বিষয়ে যুক্তির পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সূচনার প্রচেষ্টা। বইটি তাঁর সমগ্র অভিপ্রায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তা তাঁর কর্মতৎপরতার অর্ধেক মাত্র। তাঁর অভিপ্রায় ছিল পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার, নামমাত্র স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্তের পরিবর্তে। মেজাজের দিক থেকে তিনি ছিলেন পুরোপুরি বুদ্ধিবাদী, তবে তাঁর বুদ্ধিবাদের চরিত্র এরিস্টটলীয় নয়, বেকনপন্থী। কিন্তু তাঁর সূক্ষ্মদর্শিতার সঙ্গে বুদ্ধিগত সতোর প্রায় অভূতপূর্ব সম্মিলন তাঁকে কয়েকটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিচালিত করে; যে, আরোহী যুক্তির অভ্যাসের যৌক্তিক ন্যায্যতা নেই, এবং কারণবাদে বিশ্বাস কুসংস্কারে বিশ্বাস থেকে সামান্যই উন্নত। ফল দাঁড়াল ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানও ভ্রমাত্মক প্রত্যাশা এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসের অবাঞ্ছিত পর্যায়ে ঠেকল।
হিউমের মধ্যে বুদ্ধিবাদ ও সংশয়বাদ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। তবে সংশয়বাদ চর্চার ক্ষেত্রেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে এবং নিত্যদিনের ব্যবহারিক জীবনে এটি ভুলে থাকতে হবে। উপরন্তু ব্যবহারিক জীবন শাসিত হবে, যতদূর সম্ভব, সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা, যে পদ্ধতি সম্পর্কে সংশয়বাদ প্রশ্ন তুলেছে। এ ধরনের আপস সম্ভবপর এমন একজন ব্যক্তির পক্ষেই, যিনি সমানভাবে দার্শনিক এবং ইহজাগতিক; অনুপ্রাণিত ব্যক্তির ভেতর এই দুয়ে অবিশ্বাস সংরক্ষণে আভিজাতিক রক্ষণশীলতার (Toryism) আস্বাদও এতে ছিল। বৃহত্তর জগৎ কিন্তু হিউমের মতবাদ সম্পূর্ণ গ্রহণে অস্বীকার করে। তাঁর অনুসারীগণ তাঁর সংশয়বাদ বাতিল করে দেন, পক্ষান্তরে তাঁর প্রতিপক্ষরা বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিকোণের ফল হিসেবে এই তত্ত্বের উপর জোর দেন। হিউমের দর্শনের ফলে ব্রিটিশ দর্শন হয়ে পড়ে অগভীর, জার্মান দর্শন হয়ে পড়ে বুদ্ধিবাদবিরোধী এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অসহনীয় অজ্ঞেয়তাবাদের ভীতি কাজ করে। ইউরোপীয় চিন্তা তার অতীতের ঐকান্তিকতা আর পুনরুদ্ধার করতে পারে নি; হিউমের প্রতিটি অনুসারীর কাছে মানসিক ভারসাম্যের অর্থ দাঁড়ায় অগভীরতা, গভীরতার অর্থ দাঁড়ায় নির্দিষ্ট মাত্রার উন্মাদগ্রস্ততা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপযোগী দর্শনের উপর অতি সাম্প্রতিককালীন আলোচনায় হিউম-উত্থাপিত পুরাতন বিতর্ক পুনরায় শুরু হয়েছে।
বিশেষভাবে জার্মান ছাপ-যুক্ত দর্শন সূচিত কান্টের সঙ্গে, এবং হিউমের দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কান্ট কারণবাদ, ঈশ্বর, নৈতিকতা, নৈতিক আইন এবং অনুরূপ আরো অন্যান্য ব্যাপারে বিশ্বাস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তিনি উপলব্ধি করলেন হিউমের দর্শন এসবে বিশ্বাস কঠিন করে তুলেছে। ফলে তিনি উদ্ভাবন করলেন বিশুদ্ধ যুক্তি এবং ব্যবহারিক যুক্তির মধ্যে পার্থক্য। বিশুদ্ধ যুক্তির কাজ হলো যা-কিছু প্রমাণ করা সম্ভব তাই নিয়ে, যা অধিক পরিমাণে ছিল না; ব্যবহারিক যুক্তি হলো পুণ্য অর্জনের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন, এটা খুবই বেশি পরিমাণে ছিল। এটা সুস্পষ্ট যে বিশুদ্ধ যুক্তি যুক্তি মাত্র, পক্ষান্তরে ব্যবহারিক যুক্তি পক্ষপাতদোষদুষ্ট। অনুরূপভাবে দর্শনে এমন জিনিসের প্রতি আবেদন ফিরিয়ে আনলেন যা তাত্ত্বিক যুক্তিশীলতার বহির্ভূত ব্যাপার বলে স্বীকৃত, স্কলাসটিমিজমের অভ্যুদয়ের পর যা স্কুলগুলো থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কান্টের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাঁর অব্যবহিত উত্তরসূরি ফিশতে, যিনি দর্শন থেকে রাজনীতিতে এসে এমন আন্দোলনের উদ্বোধন করেন যা জাতীয় সমাজতন্ত্র নামে বিকাশ লাভ করেছে। তবে ফিশতে সম্পর্কে বলার আগে যুক্তির ধারণা সম্পর্কে আরো কিছু বলবার রয়েছে।
হিউমের মতবাদের উত্তর খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতা থেকে, যুক্তি-কে আর কিছুতেই পরম গণ্য করা চলে না। যে অবস্থা থেকে যে কোনো ধরনের প্রস্থান তাত্ত্বিক কারণে নিন্দিত হতে পারে। তথাপি একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য থেকে যায় এবং পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, দার্শনিক র্যাডিকেলদের মনের গঠন এবং প্রথম যুগের মুসলমান ধর্মোন্মত্তদের পার্থক্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে। যদি আমরা প্রথম দলের সদস্যদের যুক্তিশীল এবং দ্বিতীয় দলভুক্তদের যুক্তিবিবর্জিত গণ্য করি, তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাম্প্রতিককালে অ-যুক্তি গজিয়ে উঠেছে।
আমি মনে করি আমরা যাকে বাস্তবে যুক্তি মনে করি তা তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। প্রথমত, এটা বলপ্রয়োগ নয়, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজের পক্ষপাতী; দ্বিতীয়ত, এর কাজ হলো যুক্তিতর্ক দ্বারা বোঝানো, এবং যারা এ কাজটি করেন তারা তাদের যুক্তিকে সম্পূর্ণ বৈধ জ্ঞান করেন; তৃতীয়ত, মতামত গঠন করতে গিয়ে, যত বেশি সম্ভব পর্যবেক্ষণ এবং আরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করেন, এবং সজ্ঞার উপর নির্ভর করে কম। প্রথম যুক্তিটি ইনকুইজিশন বাতিল করে দেয়; দ্বিতীয়টি বাতিল করে ব্রিটিশ যুদ্ধ-প্রচার পদ্ধতির মতো ঘটনা, যা হিটলার এই যুক্তিতে প্রশংসা করেন যে প্রচার অবশ্যই এর মানসিক উন্নতি ডুবিয়ে দেবে গভীরে কি সংখ্যক লোককে এর নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে তার সমানুপাতে। দ্বিতীয়টি এই ধরনের রাশভারি প্রস্তাব প্রয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যেমন মিসিসিপি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বলেছিলেন, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রভু চান যে এই বিরাট উপত্যকা একটি জাতির শরিক হবে, এটি তাঁর কাছে ছিল স্বতঃসিদ্ধ, তাঁর শ্রোতাদের কাছেও, কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তার কাছে এটা সহজে প্রমাণ করা যায় নি।