গ্রেট ব্রিটেনে, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, যা যুদ্ধের পর থেকে দলগত বিভাগের ভিত্তি হয়ে রয়েছে, অধিকাংশ শিল্পপতিকে মুদ্রা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলো বুঝতে অসমর্থ করে তুলেছে। যেহেতু আর্থিক যোগান সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে তাই ধনীদের ভেতর একটা ঝোঁক পড়েছে যে, ব্যাংকার এবং অর্থের যোগানদারদের পদক্ষেপ অনুসরণ করে চলতে হবে। অথচ বাস্তব এই যে, ব্যাংকারদের স্বার্থ শিল্পপতিদের বিপরীত। মুদ্রা-সংকোচ ব্যাংকারদের অনুকূলে ছিল। পক্ষান্তরে এটা ব্রিটিশ শিল্পপতিদের পঙ্গু করেছে। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, মজুরদের যদি কোনো প্রকার ভোট না থাকত তাহলে যুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ রাজনীতি অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিদের দ্বন্দ্বের ভেতর গঠিত হতো। যাহোক, অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিরা এক জোট হয়ে যায় মজুরদের বিরুদ্ধে; শিল্পপতিরা অর্থের যোগানদারদের সমর্থন করে এবং দেশটা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায় এজন্য যে, ফরাসিরা অর্থের যোগানদারদের পরাস্ত করে।
শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নয়, গোটা বিশ্বেই সাম্প্রতিককালে অর্থের যোগানদারদের স্বার্থ সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এই অবস্থাটা নিজের থেকে পরিবর্তিত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো আধুনিক গোষ্ঠীর ধনী হবার সম্ভাবনা নেই যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আর্থিক ব্যাপার অর্থের যোগানদারদের স্বার্থে কাজ করে। অবস্থাটা এরকম দাঁড়ালে অর্থের যোগানদারদের অবাধে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের সুযোগ দেয়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ হবে না। কোনো কোনো ব্যক্তি কিউরেটরের লাভের জন্য জাদুঘর চালাতে পারেন। তাকে এই স্বাধীনতাও দিতে পারেন উচ্চ মূল্য প্রদানের প্রস্তাব এলে তিনি জাদুঘরে রক্ষিত সামগ্রী বেচে দিতে পারবেন। কিছু কিছু কাজ আছে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফার অভিপ্রায় সর্বসাধারণের অনুকূলে কাজ করে। আবার কিছু কিছু কাজের ফলাফল উল্টা দাঁড়ায়। আর্থিক ব্যাপারটা, আগের দিনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, বর্তমানে অবশ্যই শেষোক্ত শ্রেণিতে পড়ে। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, আর্থিক ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। এখন দরকার হবে আর্থিক এবং শিল্পের ব্যাপারটা একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা, আর লক্ষ্য থাকবে এই একক সত্তা থেকে সর্বাধিক মুনাফা লাভ। আর্থিক ব্যাপারটা আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। উভয়ে যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে তখন অর্থ শিল্পের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু শিল্পের স্বার্থের সঙ্গে গোষ্ঠীর স্বার্থ অধিকতর মেলে। অর্থের স্বার্থের সঙ্গে যেমন ততটা নয়। অর্থের অতিরিক্ত ক্ষমতার জোরেই বর্তমান বিশ্বের এই হাল হয়েছে।
যেক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তি অধিক ব্যক্তির উপর ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হয়েছে তারা সব সময়ই ঐ অধিক ব্যক্তির কিছু কিছু কুসংস্কারের দরুন সহায়তা পেয়েছে। প্রাচীন মিশরের পুরোহিতরা চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের সম্পর্কে ভবিষ্য-কথনের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, যা তখনও জনগণ আতঙ্কজনক ব্যাপার বলে গণ্য করতেন; এর সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা মূল্যবান উপহার আদায় এবং ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হন। অন্য কোনো উপায়ে এটা সম্ভব হতো না। রাজা-বাদশাদের এক সময় স্বর্গীয় সত্তা মনে করা হতো। ফলে ক্রোমওয়েল প্রথম চার্লসের মুণ্ডু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাঁকে এই দোষে দুষ্টু জ্ঞান করা শুরু হয় যে তিনি পবিত্র দেহ অপবিত্র করেছেন। আজকের দিনে অর্থের যোগানদারগণ জনগণের স্বর্ণের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ কুসংস্কারের উপর নির্ভর করেন। সাধারণ নাগরিক ভয়ে হতভম্ব হয়ে যায় যখন সে মজুদ স্বর্ণ, ইস্যুকৃত নোট, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রাসংকোচ, পুনঃমুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি এবং আরো অনেক অজানা পরিভাষার ভেলকিবাজি সম্পর্কে শুনতে পায়। তখন তার মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে, যে ব্যক্তি এই সব ব্যাপার নিয়ে অনর্গল কথা বলতে পারেন তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি হবেন। এবং এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন জাগলেও জিজ্ঞেস করতে সাহস করেন না। তিনি বুঝতে পারেন না যে আধুনিক লেন-দেন ব্যাপারে বাস্তবিক পক্ষে স্বর্ণের ভূমিকা কত ক্ষুদ্র, অথচ স্বর্ণের ভূমিকা সম্পর্কে তাকে ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বিপাকে পড়বেন। তিনি অস্পষ্টভাবে অনুভব করেন যদি বেশ কিছু পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকে তবে দেশ অধিকতর নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে। কাজেই দেখা যাবে, স্বর্ণের মজুদ বাড়লে তিনি খুশি হন, কমলে বড়ই বিষণ্ণ।
সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরনের বুদ্ধিহীন শ্রদ্ধার অবস্থাই গণতন্ত্রের দ্বারা শৃঙ্খলামুক্ত থাকার জন্য অর্থের যোগানদারদের দরকার। অর্থের যোগানদারগণ অবশ্য গণমতের সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে আরো কিছু সুবিধা পান। অত্যন্ত ধনবান বলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অকাতরে অর্থ দান করতে পারেন, এতে বিদ্যায়তনিক মতের প্রভাবশালী অংশ তার অনুগত থাকে। ধনিকতন্ত্রের মাথায় বসে আছেন বলে যাদের রাজনৈতিক চিন্তা কম্যুনিজমের ভয়-তাড়িত তাদের স্বাভাবিক নেতায় পরিণত হন। অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী বলে সমগ্র জাতির ভেতর খেয়াল খুশি মতো সমৃদ্ধি কিংবা সর্বনাশ বিতরণ করতে পারেন। আমার সংশয় হয়, কুসংস্কার না থাকলে এই উপায়গুলোর কোনোটা সম্পূর্ণ উপযোগী হতো কি-না। একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, অর্থ শাস্ত্র প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়টা কোনো বিদ্যালয়ে একেবারে পড়ানো হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও একটা সংখ্যালঘু শ্রেণিই শুধু এই বিষয়ে শিক্ষা পেয়ে থাকে। উপরন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার দরুন এ বিষয়ে যে ধরনের শিক্ষা তাদের পাওয়া উচিত ছিল তা তারা পায় না। গুটিকয় প্রতিষ্ঠান মাত্র ধনিক শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে অর্থশাস্ত্রে শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। কার্যত অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা গৌরবান্বিত করার জন্য শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। অনুমান করি, আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য কুসংস্কার ও রহস্যময়তা যে অত্যন্ত জরুরি এসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে।