অনেকানেক ব্যাপারের মধ্যে অতিসাধারণ একটা ব্যাপার হলো সঞ্চয় থেকে ধার দেওয়া। যেহেতু সভ্য সরকার সমূহের প্রধান খরচ হলো অতীত যুদ্ধের ব্যয় পরিশোধ কিংবা ভবিষ্যতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি; সেহেতু এই দিক থেকে বিচার করলে যিনি সরকারকে ধার দেন তার অবস্থান শেক্সপিয়রের সেই সব দুশ্চরিত্র ব্যক্তির মতো যারা আততায়ী (খুনীও বলা যায়) ভাড়া করেন। তাহলে ঐ ব্যক্তির আচরণে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়, যে রাষ্ট্রকে তিনি তার সঞ্চয় থেকে ধার দিচ্ছেন। তাহলে এটা পরিষ্কার যে তিনি যদি তার টাকা শুধু শুধু খরচ করে ফেলতেন, কিংবা এমনকি মদ্যপান করে কিংবা জুয়া খেলে ব্যয় করতেন, সেটা অনেক ভালো কাজ হতো।
আমাকে কিন্তু বলা হবে সঞ্চয় শিল্পায়নের উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হলে গোটা ব্যাপার ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। এই ধরনের উদ্যোগ সফল হলে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করলে, কথাটা মেনে নেয়া যায়। আজকের দিনে, কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অধিকাংশ শিল্প উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এর অর্থ হলো একটা বিরাট শ্রমশক্তি, যা নিয়োজিত করা যেতে পারত উপভোগ্য সামগ্রী উৎপাদনে, তা ব্যয় করা হয় যন্ত্র উৎপাদনে এবং উৎপাদনের পর ঐ যন্ত্র অলস হয়ে পড়ে থাকে এবং আর কারো কোনো কাজে লাগে না। যে ব্যক্তি এমন উদ্যোগে বিনিয়োগ করে যে উদ্যোগ দেউলে হয়ে পড়ে, সে অপরকে এবং নিজেকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি তিনি ভোজনোৎসবে বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে খরচ করেন, তবে তারা (আমি আশা করি) সুখ পাবেন, এবং যাদের জন্য তিনি খরচ করবেন তাদের সবাই সুখ পাবে, এদের মধ্যে কসাই, ময়রা, অবৈধ মদ্য প্রস্তুতকারক এবং বিক্রেতাকে ধরা যায়। কিন্তু তিনি যদি রেলপথ বসানোর জন্য ব্যয় করেন (আমি ধরে নিচ্ছি) এবং উক্ত ব্যয়ে এমন এক জায়গায় রেলপথ বসান যেখানে রেলপথের দরকার নেই তাহলে তিনি এমন ক্ষেত্রে বিরাট শ্রমনিয়োগ করলেন যা কারো সুখের কারণ হলো না। তথাপি, তিনি যখন ব্যর্থ বিনিয়োগের জন্য দরিদ্রে পরিণত হবেন তখন তাকে গণ্য করা হবে অযথা দুর্ভাগ্যের শিকার, অথচ একজন অমিতব্যয়ী, যিনি জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেছেন, তাকে অবজ্ঞা করা হবে নির্বোধ এবং লঘুচিত্ত ব্যক্তি হিসেবে।
এতক্ষণ যা কিছু বলা হলো তা প্রাথমিক ব্যাপার মাত্র। আমি আসলে গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই যে, কর্ম পুণ্যময় এই ধারণা থেকে আধুনিক জগতে বিরাট ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং আমরা কেবল কম কাজ করে সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে কাজ কী? কাজ দুই প্রকারের: প্রথমত পৃথিবীর উপরিভাগে, অন্তত কাছাকাছি, বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন, অন্যান্য বস্তুর তুলনায় দ্বিতীয়ত, অপরকে অনুরূপ কাজ করতে বলা। প্রথম কাজটি বিরক্তিকর এবং এর জন্য পারিশ্রমিকও কম মেলে; দ্বিতীয় কাজটি অত্যন্ত মজাদার এবং এর জন্য বিরাট পারিশ্রমিক লাভ করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় কাজটির পরিধি অনির্দিষ্টভাবে বিস্তৃত করা সম্ভব। কারণ যারা আদেশ প্রদান করেন তারাই শুধু নয়, যারা কী আদেশ প্রদান করা উচিত তার পরামর্শ দেন তারাও এর মধ্যে রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই একযোগে পরস্পরবিরোধী দুটি উপদেশ প্রদান করা হয় দুটি সংগঠিত শ্রেণি কর্তৃক; এর নামই রাজনীতি। এই ধরনের কাজের উপদেশের জন্য যে দক্ষতার দরকার করে তার সঙ্গে উক্ত বিষয়ের জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, এখানে শুধু দরকার মানুষকে প্রভাবিত করার উপযোগী বক্তৃতা প্রদানের কায়দার অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের জ্ঞান। লেখালেখি করেও বিজ্ঞাপনের কাজ সম্পন্ন করা যায়।
গোটা ইউরোপে, আমেরিকায় যদিও নয়, তৃতীয় এক শ্রেণির লোক রয়েছেন যাদের আলোচিত দুই শ্রেণির চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা করা হয়। এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন, যারা ভূমির মালিকানার সুবাদে, অপরকে বেঁচে থাকা এবং কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তাদের কিছু প্রদানে বাধ্য করতে পারেন। এই ভূস্বামীরা অলস। অতএব, আমার প্রতি হয়তো আশা করা হবে যে আমি এদের প্রশংসা করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের পক্ষে অলস হওয়া সম্ভব হয় অপরের শ্রমের জন্য। বাস্তবিকপক্ষে, তাদের আরামদায়ক আলস্যের বাসনা থেকেই ঐতিহাসিকভাবে কাজের প্রশংসার জন্ম নিয়েছে। আবার একটা জিনিস তারা একেবারেই কামনা করে না, তা হলো তাদের উদাহরণ অন্যেরা অনুসরণ করুক।
সভ্যতার শুরু থেকে শিল্পবিপ্লবের সময় পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের কিছুটা অধিক উৎপাদন করতেন, যদিও তার স্ত্রী তার মতোই পরিশ্রম করতেন, এবং তার সন্তানেরা বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের জন্য শ্রম দিতেন। কিন্তু যে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকত তা উৎপাদক পেতেন না, যোদ্ধা এবং পুরোহিতরা তা ভোগ করতেন। দুর্ভিক্ষের সময় কোনো উদ্বৃত্ত থাকত না, কিন্তু যোদ্ধা ও পুরোহিতগণ অন্যান্য সময়ের মতোই দুধ-ভাত খেতেন, ফলে অনেক শ্রমিক অনাহারে মারা যেতেন। এই অবস্থা রুশদেশে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিরাজ করেছে, প্রাচ্যে এখনও বিরাজ করছে; বিলেতে শিল্পবিপ্লব সত্ত্বেও নেপোলিয়নের যুদ্ধবৃত্তি চলাকালে এই অবস্থা দাপটের সঙ্গে চালু থাকে এবং একশো বছর আগেও নতুন উৎপাদনকারীদের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত চালু ছিল। আমেরিকায় বিপ্লবের সঙ্গে-সঙ্গে এই অবস্থার অবসান ঘটে, তবে ব্যতিক্রম ছিল দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে গৃহযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ব্যাপারটা বজায় ছিল। যে ব্যবস্থা এত দীর্ঘকাল বজায় ছিল এবং অবসান ঘটে অতি-সাম্প্রতিককালে, তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চিন্তাচেতনায় গভীর ছাপ রাখে। আমরা যে কাজের প্রয়োজনীয়তাকে এতটা অনিবার্য মনে করি তার উৎস কিন্তু এই ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা শিল্পবিপ্লবের আগের বলে আধুনিক জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে নি। আধুনিক প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতার ভেতর হলেও অবসর ভোগ সম্ভব করে তুলেছে, তবে ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী শ্রেণির বিশেষ অধিকার ভোগের জন্য নয়, সমগ্র গোষ্ঠীতে অবসর ভোগ সমানভাবে অধিকার হিসেবে বণ্টনের জন্য। কর্মের নৈতিকতা ক্রীতদাসের নৈতিকতা আর আধুনিক জগতে ক্রীতদাস প্রথার কোনো প্রয়োজন নেই।