তেল ব্যাপারে যা প্রযোজ্য, ঋণ ব্যাপারেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মুদ্রার মান। কমানো কিংবা ঋণ পরিশোধ অস্বীকার যখন সরকারের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে, সরকার তখন তা করে থাকে। সত্য যে, কোনো-কোনো দেশ ঋণ পরিশোধের নৈতিক গুরুত্ব বিষয়ে লম্বা-চওড়া কথা বলে থাকে। আসল ব্যাপার হলো ঐ দেশগুলো ঋণ দিয়ে বসে আছে। যতদিন ঋণগ্রস্ত দেশ তাদের কথা শোনে, সে শুধু তাদের শক্তি আছে বলে, নীতিগত দিক বুঝে করে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুদ্রার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার একটা উপায়ই রয়েছে, আর তা হলো, বিশ্ব-সরকার গঠন। এই সরকারের অধীনে থাকবে সমগ্র সামরিক শক্তি। স্থায়ী মুদ্রা ব্যাপারে এই সরকারের স্বার্থ থাকতে হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে সমর্থ স্থায়ী ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রা চালু করবে। এটাই একমাত্র সত্য স্থায়িত্ব এবং স্বর্ণের এই স্থায়িত্ব প্রদানের ক্ষমতা নেই। সার্বভৌম দেশগুলো দুঃসময়ে স্বর্ণে নির্ভরতা বজায় রাখে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণ মুদ্রা স্থায়িত্ব বিধান করে এই যুক্তি যে কোনো দিক বিচারে ভ্রমাত্মক।
যারা নিজেদের বড় বেশি বাস্তববাদী বলে বিবেচনা করে তারা আমাকে পুনঃপুন জানান যে, ব্যবসায়ীরা সাধারণত ধনী হওয়ার অভিলাষ পোষণ করে। পর্যবেক্ষণ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আমাকে যারা এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন তারা বাস্তববাদী হওয়া তো দূরের কথা, তারা হলেন আবেগতাড়িত আদর্শবাদী মাত্র, যে জগতে তারা বাস করেন সেই জগতের মৌলিক বাস্তবতা তারা দেখতে পান না। ব্যবসায়ীরা যদি অপরকে দরিদ্র রাখার চেয়ে নিজেরা ধনী হওয়ার জন্য বাস্তবিক ইচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে জগত্তা দ্রুত স্বর্গে পরিণত হয়ে যেত। ব্যাংকিং এবং মুদ্রা থেকে একটা সুন্দর উদাহরণ আহরণ করা যায়। ব্যবসায়িক শ্রেণির সাধারণ স্বার্থই হলো এটা দেখা যে মুদ্রা স্থায়ী এবং ঋণ নিরাপদ। এই দুটি হাসিলের জন্য স্পষ্টতই সারা জগতে একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকা দরকার। এই মুদ্রা অবশ্যই কাগজী হবে, যা পণ্য-সামগ্রীর গড়-মূল্য যতটা সম্ভব স্থির রাখবে। এই মুদ্রার ভিত্তি গোল্ড রিজার্ভ হওয়ার দরকার করে না। বরং বিশ্ব-সরকারের সুনাম বা ঋণ পরিশোধের সামর্থের উপর নির্ভর করবে। এবং বিশ্ব-সরকারের আর্থিক লেন-দেনের সংগঠন একটি থাকবে, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাপারগুলো এত স্বচ্ছ যে একটি শিশুর পক্ষেও তা বোঝ সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রস্তাবই ব্যবসায়ীদের দিক থেকে আসে না। কেন? জাতীয়তাবাদই এর কারণ। নিজেরা ধনবান হওয়ার চেয়ে অপর দেশকে দরিদ্র রাখতে তাদের আগ্রহ বেশি।
অপর একটি কারণ হলো, উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব। এটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলেই মনে হয় যে, টাকা ব্যবহার্য বস্তু শুধু এ কারণে যে টাকা দিয়ে পণ্য-সামগ্রী বিনিময় চলে। তবু খুব কম লোকই আবেগগত এবং যৌক্তিকভাবে তা সত্য মনে করেন। প্রায় প্রত্যেক লেন-দেনের ব্যাপারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি খুশি হয়। আপনি এক জোড়া জুতো কেনেন তখন বিক্রেতা বিপণনের যাবতীয় কায়দা আপনার উপর আরোপ করে এবং বিক্রেতা ধরে নেন তিনি একটা ছোটোখাটো বিজয় অর্জন করেছেন। অপরপক্ষে আপনি মনে-মনে বলবেন না যে কি সুন্দর! ঐ নোংরা কাগজের টুকরোগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া গেল, যে টুকরাগুলো আহার্য হিসেবে গ্রহণও করতে পারতাম না, পোশাক হিসেবে ব্যবহারও চলত না। মাঝখান থেকে এক জোড়া চমৎকার জুতো পেয়ে গেলাম। আমার ক্রয়ের ব্যাপারটা বিক্রয়ের তুলনায় কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ঘটে যখন সরবরাহ হয় সীমিত। যে ব্যক্তি ওল্ড মাস্টারের চিত্রকর্ম ক্রয় করে সে বিক্রেতার চেয়ে বেশি খুশি হয়। কিন্তু ঐ ওল্ড মাস্টার যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি নিশ্চয় তার পৃষ্ঠপোষকের (ক্রেতার) চেয়ে বেশি খুশি হতেন। ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি করে আমরা যে বেশি আনন্দিত হই তার মূল মনস্তাত্ত্বিক উৎস হলো সুখের চেয়ে ক্ষমতা আমরা বেশি পছন্দ করি। এটা সার্বিক চরিত্র নয়; এমন কিছু অমিতব্যয়ী ব্যক্তিও রয়েছেন যারা অনতিদীর্ঘ এবং আনন্দময় জীবন পছন্দ করেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য শক্তিমান ও সফল ব্যক্তিদের, যারা প্রতিযোগিতামূলক যুগে সামঞ্জস্য আনেন। যে কালে সকল সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা হতো তখন উৎপাদনের মনস্তত্ত্ব কম আধিপত্য করেছে। উৎপাদকের মনস্তত্ত্বই মানুষকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী করে তোলে। এবং এ জন্যই সরকারসমূহ এমন জগৎ সৃষ্টির হাস্যকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় যেখানে প্রত্যেক জাতি শুধু বিক্রি করে, কোনো জাতি ক্রয় করে না।
একটা অবস্থার জন্য উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব জটিল হয়ে যায়। এই অবস্থাটা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিশিষ্টতা দান করে। যদি কিছু আপনি উৎপাদন এবং বিক্রয় করেন তা হলে দুই ধরনের মানুষ আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনার ব্যবসার প্রতিযোগী এবং খদ্দেরগণ। প্রতিযোগী আপনার ক্ষতি করে। খদ্দের দ্বারা আপনি লাভবান হোন। প্রতিযোগীদের আপনার চেনা আছে, তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যাও কম, পক্ষান্তরে খদ্দেররা ছড়ানো-ছিটানো এবং অনেকাংশে অচেনা। ফলে আপনি খদ্দেরের চেয়ে প্রতিযোগীর প্রতি বেশি সচেতন হবার চেষ্টা করেন। এটা স্বীয় গোষ্ঠীর ভেতর না ঘটতে পারে, কিন্তু গোষ্ঠী যদি বাইরের হয় তাহলে এটা ঘটবেই। এবং ঐ গোষ্ঠীকে আপনার স্বার্থের প্রতিকূলে বলে ধরা হবে। এই বিশ্বাসই সংরক্ষণমূলক শুল্কের উৎস। বিদেশকে সম্ভাব্য খদ্দের হিসেবে না দেখে উৎপাদনে প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ বিদেশি প্রতিযোগীতা এড়ানোর জন্য বিদেশি বাজার হারাতে রাজি থাকে। এক ছোট্ট শহরে এক কসাই ছিল, সে অন্যান্য কসাইয়ের উপর চটে গেল, কারণ তারা তার খদ্দের কেড়ে নিয়েছে। উক্ত কসাই প্রতিজ্ঞা করে বসল সে সবার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে সে শহরটি নিরামীষ ভোজীতে পরিণত করল। অতঃপর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করতে হলো যে সে নিজেরও ধ্বংস ডেকে এনেছে। উক্ত কসাইয়ের বোকামি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। তবু তার বোকামি বৃহৎ শক্তিগুলোর বোকামির চেয়ে বেশি নয়। সবাই লক্ষ্য করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য অপরাপর জাতিকে ধনী করে এবং সবাই শুল্কের দেয়াল খাড়া করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য ধ্বংস করার জন্য। আর সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, তাদের প্রতিযোগীদের সমানই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ ভেবে দেখেন নি যে, বাণিজ্য পারস্পরিক ব্যাপার এবং কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্র যখন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে, একই সঙ্গে ক্রয়ও করে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। ব্যাপারটা ভেবে দেখা হয় নি এজন্য যে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ জাতির প্রতি ঘৃণা তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে স্বচ্ছভাবে ভাবতে অসমর্থ করে তুলেছে।