সকল প্রয়োজনীয় পেশার মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর বা বিকট পেশা হলো সোনার খনিশিল্প। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সোনা উত্তোলন করা হয় ও চৌর্যবৃত্তি এবং দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অপরিসীম সাবধানতা অবলম্বন করে উক্ত সোনা লন্ডন, প্যারিস এবং নিউইয়র্কে আনা হয়। এবং এই শহরগুলোর ব্যাংকের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টে রাখা হয়। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার ভূ-গর্ভেই এই সম্পদ সংরক্ষণ করা যেত। ব্যাংকে ভবিষ্য প্রয়োজনে আমানত হিসেবে রাখলে তার কিছুটা উপযোগিতা থাকে, কিন্তু যদি বলা হয় এই আমানত নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে কোনোদিন নামতে দেয়া যাবে না তাহলে ঐ আমানত না থকার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমি বলি বৃষ্টির দিনে কাজে লাগানোর জন্য ব্যাংকে এক শো পাউন্ড জমা রাখবো, সে কাজটা বিজ্ঞজনোচিত কাজই হবে। কিন্তু যদি আমি বলি যে, যত দরিদ্রই আমি হই ঐ এক শো পাউন্ডে আমি কোনদিন হাত দেব না তাহলে উক্ত টাকা আমার সম্পদের কার্যকরী অংশ হিসেবে আর থাকল না। এমন বলা যায় যে, ঐ টাকা আমি কাউকে দিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত যদি কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা না হয়। জাতীয় ক্রেডিটের একটা অংশ যদি এখন প্রকৃত স্বর্ণে রাখা হয় তবে তা নিতান্তই বর্বরতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণের ব্যবহার উঠে গেছে। যুদ্ধের আগে কিছু পরিমাণে এর ব্যবহার ছিল, কিন্তু যারা যুদ্ধের পর বড় হয়ে উঠেছেন তারা স্বর্ণমুদ্রার চেহারাই দেখেন নি। তথাপি ভেলকিবাজি দেখিয়ে বলা হয় যে জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব নির্ভর করে কথিত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোনা মজুদের উপর। যুদ্ধ চলাকালে সাবমেরিনের জন্য সোনা পরিবহন যখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় তখন এই কাল্পনিক ব্যাপারটা আরো অনেক দূর গড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উত্তোলিত স্বর্ণ কেউ ধরে নেয় যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, কেউ ধরে নেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা অন্য কোনো জায়গায়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ সোনা দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ছিল। কল্পনাটা আরো একটু বাড়িয়ে কেন ধরা হলো না যে খনি থেকে উত্তোলন করে সেখানেই রেখে দেয়া হয়।
তত্ত্বগতভাবে স্বর্ণ মজুদে সুবিধা এই যে, তা অসাধু সরকারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ সংকটকালে সরকারকে স্বর্ণমান মেনে চলতে বাধ্য করার কোনো উপায় নেই। বস্তুত সরকার সুযোগ বুঝে বা বিপদে পড়লে স্বর্ণমান বর্জন করে। বিলম্বে যুদ্ধে যোগ দেয়া ইউরোপের দেশগুলো তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে ঋণের একটা অংশ পরিশোধের দায় এড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ সমগ্র ঋণ পরিশোধের দায় এড়ায়। ফ্রান্স তার মুদ্রার মান এক-পঞ্চমাংশ কমিয়ে দিয়ে ফ্রা-তে হিসেবকৃত ঋণের পাঁচ ভাগের চারভাগ দায় অস্বীকার করে। স্বর্ণে পাউন্ড স্টার্লিং-এর মান আগের মূল্যের তুলনায় এখন চারভাগের তিন ভাগ মাত্র। রুশদেশ খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ঋণ পরিশোধ করবে না। তবে এটা দুষ্ট আচরণ, রুশদের এই আচরণ কোনো দেশ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি; সম্মানজনকভাবে ঋণদায় এড়ানোর জন্য দ্রভাবে তা করতে হয়।
ব্যাপারটা হলো, যে কোনো সরকার, জনগণের মতোই স্বার্থের অনুকূলে হলেই শুধু ঋণ পরিশোধ করে, অন্যথায় নয়। বিশুদ্ধ আইনগত নিশ্চয়তা, যেমন স্বর্ণমান, প্রতিকূল সময়ে কোনো কাজে লাগে না। অন্য সময় এর দরকার করে না। কোনো ব্যক্তি সাধু হওয়াটা ততক্ষণ লাভজনক মনে করে যতক্ষণ সে ধার নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে এবং ধার পরিশোধের ক্ষমতা রাখে। ধার পরিশোধের সামর্থ হারালে তখন গা ঢাকা দেয়াটাই সুবিধাজনক মনে করে। একটি সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে যে আচরণ করে অপর দেশের সঙ্গে আচরণের তুলনায় তা আলাদা জাতের। দেশের জনগণ সরকারের করুণার উপর নির্ভরশীল, অতএব, তাদের প্রতি সদাচরণের কোনো ইচ্ছাই সরকারের নেই, যদি না পুনরায় ধার নেয়ার অভিলাষ থাকে। যুদ্ধের পর জার্মানিতে যেমন ঘটেছিল, যখন দেখা যায় দেশের ভেতর থেকে ধার পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন চালু মুদ্রা মূল্যহীন করলে কাজ হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ সমস্ত দেনা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্য দেশ থেকে নেয়া ঋণের ব্যাপারটা আলাদা। রুশদেশ যখন অপরদেশ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাল তখন তাকে সমগ্র সভ্য জগতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে চলল মারমুখী প্রচারণা। অধিকাংশ দেশ এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অসমর্থ, ফলে অন্য দেশ থেকে গৃহীত ঋণ সম্পর্কে সতর্ক থাকে। স্বর্ণ-মান নয়, যুদ্ধভীতিই অপর দেশকে দেয়া ঋণের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। এই নিরাপত্তা ঠুনকো এবং আন্তর্জাতিক সরকার গঠন ভিন্ন অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।
আর্থিক লেন-দেন কতটা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে তা অনেক সময় অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। অনেকটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি দ্বারা সম্পদের মালিকানা অর্জন করা হয়, কিন্তু উক্ত ব্যবসায়িক বুদ্ধি কেবল সম্ভব সেনা ও নৌশক্তির কাঠামোর ভেতর। সামরিক শক্তির জোরেই ওলন্দাজরা ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে নিউইয়র্ক কেড়ে নেয়, আবার ওলন্দাজদের কাছ থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয়, সামরিক শক্তির বলেই মার্কিনীরা দখল কায়েম করে ইংরেজদের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন তেল আবিষ্কৃত হলো তার মালিক হলো মার্কিন নাগরিকগণ। কিন্তু কম শক্তিধর দেশে তেল আবিষ্কৃত হলে ছলে-বলে-কৌশলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি-র নাগরিক তার মালিকানা লাভ করে বসে। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয় তা গোপন থাকে। কিন্তু পেছনে ওৎ পেতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি। সুপ্ত হুমকিই চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় সাহায্য করে।