আমি বলছি না যে, জার্মানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবিই আমাদের সকল অসুবিধার একমাত্র কারণ। এতে আমেরিকার কাছে মিত্রশক্তির দেনারও অবদান রয়েছে। অনুরূপভাবে, পরিমাণে কম হলেও ব্যক্তিগত ও সরকারি দেনাও অবদান রেখেছে, যেখানে ঋণদাতা ও গ্রহীতাকে শুল্কের উঁচু দেয়াল বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধ হয়ে পড়েছে দুষ্কর। জার্মানির ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারটা কোনো অর্থেই সমগ্ৰ অসুবিধার উৎস না হলেও, বিভ্রান্ত চিন্তার অন্যতম স্বচ্ছ উদাহরণ, যা অসুবিধা মোকাবিলা কঠিন করে তুলেছে।
যে বিভ্রান্ত চিন্তা থেকে আমাদের দুর্ভাগ্য উৎসারিত হয়েছে, তা খাতক ও উৎপাদকের দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি কিংবা আরো সঠিকভাবে বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক নিয়মের অধীন উৎপাদনের বিভ্রান্তি। ক্ষতিপূরণের দাবি যখন আরোপ করা হয় তখন মিত্রশক্তি নিজেদের ভোক্তা মনে করেছে; তারা মনে করেছে কী সুখের ব্যাপারই না হবে জার্মানি তাদের হয়ে কাজ করবে অস্থায়ী ক্রীতদাস হিসেবে এবং জার্মানি যা উৎপাদন করবে তা বিনাশ্রমে তারা ভোগ করতে সমর্থ হবে। অতঃপর ভার্সাই সন্ধি সমাধা হবার পর তাদের হঠাৎ ঠাহর হলো যে তারাও উৎপাদক। এবং তাদের দাবিকৃত জার্মান পণ্যসামগ্রীর বন্যা দেশীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস করবে। এতে তারা এতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল যে নিজেদের মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকে বসল, তখনও কিছু হলো না। মোদ্দা কথাটা এই যে, জগতের শাসক শ্রেণি এতটাই অজ্ঞ ও নির্বোধ যে সমস্যাটা নিয়ে ঠিক মতো ভাবতে তারা অসমর্থ। এবং তারা এতটাই দাম্ভিক যে যাদের সাহায্য কাজে লাগতে পারে তাদের উপদেশ গ্রহণেও অরাজি।
সমস্যাটা আরো একটু সরল করে দেখার জন্য অনুমান করা যাক, মিত্রশক্তির একটি দেশ একটি ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। ব্যক্তিটি রবিনসন ক্রুসো এবং সে একটি মরুময় দ্বীপে বাস করে। ভার্সাই চুক্তির শর্তানুসারে তাকে জার্মানরা বিনামূল্যে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে বাধ্য। কিন্তু যদি সে মিত্রশক্তিসমূহের মতো আচরণ করে তাহলে সে বলবে, না, আমার জন্য কয়লা আনার দরকার নেই। কারণ এতে আমার কাষ্ঠসংগ্রহশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য রুটি আনবে না। এতে আমার কৃষিশিল্প এবং কারখানার যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য পোশাক আনতে হবে না, কারণ এতে আমি যে পশুর চামড়া দিয়ে পরিচ্ছদ তৈরির কারখানা গড়ে তুলছি (যা এখন শিশু অবস্থায় আছে) তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তুমি সোনা সরবরাহ করলে আমি কিছু মনে করবো না। কারণ এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না; ঐ সোনা আমি গুহায় লুকিয়ে রাখব এবং কোনোদিন ব্যবহার করব না; কিন্তু আমার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হবে এমন কোনো পণ্য সরবরাহ করলে আমি তা গ্রহণ করব না। আমাদের কল্পিত রবিনসন ক্রুসো সত্যিই যদি এ ধরনের কিছু বলেন, তাহলে আমরা ধরে নেব যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে তার বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, প্রত্যেকটি জাতি জার্মানিকে তাই বলেছে। কোনো ব্যক্তি নয়, একটি জাতি যখন উন্মাদরোগগ্রস্ত হয় তখন ভাবা হয় যে জাতিটি প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে এবং উক্ত প্রজ্ঞা শিল্পকারখানা গড়ার জন্য দরকারি।
আমাদের ক্রুসো সাহেবের সঙ্গে একটি জাতির প্রাসঙ্গিক পার্থক্য এখানে যে, ক্রুসো সাহেবের সময়জ্ঞান প্রচণ্ড। পক্ষান্তরে একটি জাতির সময়জ্ঞান বলতে কিছু নেই। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই পোশাক পায়, তাহলে সে পোশাক তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করে না। কিন্তু একটি জাতি কিংবা যে কোনো জাতি মনে করে তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু তৈরি করা উচিত। (আবহাওয়ার মতো) কিছু প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক থাকলে অবশ্য ব্যতিক্রম হয়। জাতিগুলোর যদি কোনো জ্ঞানগম্যি থাকত তবে আন্তর্জাতিক সম্মতির মাধ্যমে তারা ঠিক করে নিত কোন জাতি কী উৎপাদন করবে। এবং সবকিছু উৎপাদন করার চেষ্টা করত না; কোনো ব্যক্তি যেমন সবকিছু উৎপাদনের চেষ্টা করে না। কোনো ব্যক্তিই নিজেই তার পোশাক, জুতো, মোজা, খাদ্য, বাড়ি ইত্যাদি তৈরি করার চেষ্টা করে না। তার এটা ভালোই জানা আছে। যে, সে যদি প্রয়োজনীয় সবকিছু তৈরির চেষ্টা করে তবে তার আরাম-আয়েস নিচু স্তরের হবে। কিন্তু জাতিসমূহ এখনও শ্রম বিভাগের নীতি বুঝে উঠতে পারে নি। যদি তাই বুঝত তবে তারা জার্মানিকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পণ্য দিয়ে পরিশোধ করতে দিত। এবং ঐ পণ্য নিজেরা আর তৈরি করত না। যাদের বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারা অন্য ধরনের কাজ জনগণের খরচে শিখে নিত। কিন্তু এর জন্য দরকার উৎপাদন সংগঠনের। যা ব্যবসায়িক গোঁড়ামির বিপরীত।
স্বর্ণ-সম্পর্কিত কুসংস্কারের কারণ কৌতুককরভাবে দৃঢ়মূল, এই কুসংস্কার শুধু যারা এর দ্বারা লাভবান হয় তাদেরই নয় যাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে তাদেরও এই কুসংস্কার রয়েছে। ১৯৩১ সালের শরৎকালে ফরাসিরা যখন ইংরেজদের স্বর্ণমান বর্জনে বাধ্য করে, তখন তারা ভেবেছিল এতে ইংরেজদের ক্ষতি হবে। ইংরেজরাও তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হয়। এক ধরনের লজ্জা, জাতীয় গ্লানিতে ইংল্যান্ড প্লাবিত হয়ে যায়। অথচ সেরা অর্থনীতিবিদগণ স্বর্ণমান পরিত্যাগের পক্ষে বলে আসছিলেন। পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা ঠিকই বলেছিলেন। দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের রক্ষকগণও এতটা অজ্ঞ ছিলেন যে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করা হয় ব্রিটিশ জনগণের স্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট কাজটি করার জন্য, আর ফ্রান্স তার অবন্ধুসুলভ নীতির জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইংল্যান্ডের উপকার করে বসে।