এটি একটি অত্যন্ত সাদামাটা গল্প। তবু জগৎ এই গল্পের মর্মার্থ অনুধাবন করতে হিমসিম খায়। স্পেনবাসীরা ষোড়শ শতকে যখন পেরুতে সোনা পায়, তখন তারা ভাবল এই সোনা নিজেদের কাছেই রাখতে হবে এবং সোনা যাতে বাইরে রপ্তানি না হয়ে যায় তার জন্য সমস্ত রকম প্রতিবন্ধক খাড়া করল। ফলে স্পেন অধিকৃত দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রীর দাম চড়ে গেল। এতে স্পেন প্রকৃত সম্পদের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সমৃদ্ধতর হলো না। একজন মানুষ এই ভেবে গর্ব ও সন্তোষ বোধ করতে পারেন যে, এখন তার টাকার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ, কিন্তু সে ডাবলুন যদি শুধু আগের চেয়ে অর্ধেক পণ্য ক্রয়ে সমর্থ হয়, তাহলে ঐ লাভটা আর বাস্তবিক থাকল না। এতে তার পক্ষে অধিকতর পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় ক্রয় সম্ভব হবে না, কিংবা উন্নততর বাড়ি ক্রয় করতে পারবে না বা চোখে দেখার মতো কোনো সুবিধা হবে না। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর ছিলেন বলে আজকের ইস্টার্ন ইউনাইটেড স্টেটস নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে, এই অঞ্চল সোনা না থাকায় অবজ্ঞা কুড়িয়েছে। কিন্তু সম্পদের উৎস হিসেবে এই অঞ্চল নিউ ওয়ার্ল্ডের স্বর্ণ-উৎপাদনকারী অংশের চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এলিজাবেথের যুগে নিউ ওয়ার্ল্ডের সোনা উৎপাদনকারী অংশের প্রতি সকল জাতির লোলুপ দৃষ্টি ছিল।
ইতিহাসের বিষয় হিসেবে যদিও এই ঘটনা সবার জানা তবু আজকের সমস্যায় এর প্রয়োগ সরকার সমূহের মানসিক ক্ষমতার বহির্ভূত বলেই মনে হয়। বিষয় হিসেবে অর্থ শাস্ত্রকে সকল যুগেই উল্টাপাল্টাভাবে দেখা হয়েছে, তবে ব্যাপারটা বর্তমান সময়ের জন্য যতটা সত্য আগের যে কোনো সময়ে ততটা ছিল না। যুদ্ধের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটে তা এতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে এটা বিশ্বাস করাই কঠিন সরকার যারা চালাচ্ছে, তারা সাবালক এবং তারা পাগলাগারদে বড় হয়ে ওঠেন নি। তারা জার্মানিকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল, আর বহুকাল চর্চিত শাস্তি প্রদানের পন্থা হলো ক্ষতিপূরণের দাবি আরোপ। অতএব তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করল। এতদূর ব্যাপারটা ভালোই ছিল। বিপত্তি বাঁধল এখানে যে, ক্ষতিপূরণ দাবির পরিমাণ এতটা বেশি ধরা হলো যে, জার্মানিতে যে পরিমাণ সোনা আছে দাবিকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি, হয়তো সমগ্র জগতেও এত সোনা নেই। সুতরাং গাণিতিকভাবেই জার্মানদের পক্ষে অসম্ভব পণ্য-সামগ্রী ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ে ক্ষতিপূরণ করা; জার্মানি পণ্য-সামগ্রী আকারে ক্ষতিপূরণ করতে পারবে কিংবা এ ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারবে না।
ইত্যবসরে সরকারসমূহের বোধধাদয় হলো যে, তারা একটি দেশের সমৃদ্ধির পরিমাপ করে আমদানির চেয়ে কতটা বেশি রপ্তানি করতে পারে তা দিয়ে। যখন একটি দেশ আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি করে তখন বলা হয় যে দেশটির বাণিজ্যিক ভারসাম্য অনুকূলে। ব্যাপারটা বিপরীত হলে ভারসাম্য প্রতিকূলে গণ্য করা হয়। জার্মানির পক্ষে অসম্ভব পরিমাণ সোনা দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করে প্রকারান্তরে তারা ডিক্রি জারি করে বসে যে, মিত্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য জার্মানির অনুকূলে থাকবে, আর ভারসাম্য প্রতিকূলে থাকবে মিত্রশক্তির। অতঃপর তারা আতংকের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন জার্মানির রপ্তানি বাণিজ্য চাঙ্গা করে অনিচ্ছুকভাবে বরং দেশটির উপকার করা হচ্ছে। এই সাধারণ যুক্তির সঙ্গে আরো নির্দিষ্ট কিছু যুক্তি যোগ হলো। জার্মানি এমন কিছু উৎপাদন করে না যা মিত্রশক্তি উৎপাদন করতে পারে না। জার্মান প্রতিযোগিতার হুমকি সর্বত্রই অভিযোগের আকার ধারণ করল। ইংরেজদের জার্মানির কয়লার দরকার নেই। তাদের নিজেদের কয়লাখনি শিল্পেই তখন মন্দা দেখা দিয়েছে। ফরাসিদের জার্মানির লৌহ ও লৌহজাত সামগ্রীর দরকার নেই। কারণ তারা নব-অধিকৃত লোরেন প্রদেশের আকরিকের দ্বারা নিজস্ব লৌহ ও ইস্পাত সামগ্রীর উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এমন আরো অনেক ব্যাপার। সুতরাং মিত্রশক্তি যদিও জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রইল, অপরদিকে তারা এ ব্যাপারেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো যে কোনো বিশেষ আকারে তাকে পরিশোধ করতে দেয়া যাবে না।
এই উন্মাদ পরিস্থিতির উন্মাদসুলভ সমাধানও খুঁজে পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো জার্মানি যা পরিশোধ করতে পারবে তাই তাকে ধার দেয়া হবে। বস্তুত মিত্রশক্তি বলতে লাগল; ক্ষতিপূরণ করা থেকে তোমাকে অব্যাহতি দেয়া যাবে না, কারণ এটা তোমার শয়তানির ন্যায়ানুগ শাস্তি। অপরদিকে, তোমাকে পরিশোধেরও সুযোগ দেয়া যাবে না, কারণ এতে আমাদের শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যাবে; অতএব আমরা তোমাকে ধার দেব এবং তুমি সে ধার পরিশোধ করবে। এইভাবে নিজেদের ক্ষতি না-করেও নীতিটা টিকিয়ে রাখা যাবে। তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে কথা হলো, আমরা আশা করছি ঐ ব্যাপারটা কেবল কিছুকালের জন্য মুলতবি রইল।
বলাবাহুল্য, এই সমাধান সাময়িক কালের জন্যই শুধু হতে পারে। জার্মানিকে যারা ঋণ প্রদান করল তারা ঋণের সুদ চায়। সুতরাং একই সংকট দেখা দিল যেটা ক্ষতিপূরণ ব্যাপারে দেখা দিয়েছিল। জার্মানির পক্ষে স্বর্ণ মাধ্যমে পরিশোধ সম্ভব নয়। আর মিত্রশক্তি পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধে গররাজি। অতএব সুদ পরিশোধের জন্যও ঋণ প্রদান দরকারি হয়ে পড়ল। স্পষ্টত জনগণ আগে হোক পরে হোক এই খেলায় এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। জনগণ যদি ধার দিয়ে কিছু না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলতে হবে দেশটির ক্রেডিট বা জমা ভালো অবস্থায় নেই। আর এটা যখন ঘটে তখন জনগণ পাওনা টাকার প্রকৃত পরিশোধ দাবি করে কিন্তু আমরা যেমন দেখেছি, জার্মানির পক্ষে তা সম্ভব নয়। ফলে স্থানে-স্থানে দেউলিয়া অবস্থা দেখা দিল বা লালবাতি জ্বলতে শুরু করল। প্রথমে লালবাতি জ্বলল জার্মানিতে, তারপর জ্বলল। জার্মানিকে ধারদাতা পক্ষগুলোর। তারপর তাদের মধ্যে যারা উক্ত পক্ষগুলোকে টাকা ধার দিয়ে বসে আছে; আরো ইত্যাদি। ফল দাঁড়াল সার্বিক মন্দা, দুর্বিপাক, অনাহার, ধ্বংস, সামগ্রিক বিপর্যয় এবং লাগাতর সামগ্রিক বিপর্যয়। যার দরুন সারা বিশ্ব ভুগছে।