নারী ও পুরুষ সমভাবে ক্ষুদে কামরার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবেন, সময় কাটবে সাধারণের বৃহৎ কক্ষে, যা স্থাপত্যকর্মের দিক থেকে কলেজ হলগুলোর মতোই চমৎকার হতে পারে। সৌন্দর্য ও পরিসরের সুবিধা শুধু ধনীরা ভোগ করবে, এটা কোনো মতেই আবশ্যিক হতে পারে না। অচলায়তনে আবদ্ধ থাকলে যে বিরক্তি জন্ম নেয় তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। যা পারিবারিক জীবন অনেক সময় অসম্ভব করে তোলে।
স্থাপত্যকর্মের সংস্কার করলে এই ফলগুলো পাওয়া যাবে।
একশো বছরেরও আগে রবার্ট ওয়েন অনেক পরিহাস কুড়িয়েছিলেন তাঁর সামবায়িক সামন্তরিক ক্ষেত্রর জন্য তাঁর কিন্তু প্রচেষ্টা ছিল শ্রমজীবীদের জন্য কলেজ জীবনের সুবিধা তৈরি করা। ঐ সময়ের ঘোর দরিদ্রতার জন্য উক্ত প্রস্তাব অবশ্য কালোপযোগী বিবেচিত হয়নি। তবু তার প্রস্তাবের অনেক অংশ এখন বাস্তবতার কাছাকাছি এবং কাম্য বলে বিবেচিত। তিনি নিজে নিউ লানার্কে আলোকসম্পাতী নীতির ভিত্তিতে নার্সারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিউ লানার্কের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিপথগামী হয়ে সামন্তরিক ক্ষেত্রকে উৎপাদনশীল ইউনিট গণ্য করেন, অথচ শুধু আবাসস্থল গণ্য করার কথা ছিল। প্রথম থেকেই শিল্পায়নের ঝোঁক ছিল অতিরিক্ত উৎপাদনের উপর, ভোগ ও সাধারণ জীবনযাপন গুরুত্ব পায়নি। এটা মুনাফার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের ফলশ্রুতি। আর মুনাফার সঙ্গে একমাত্র সম্পর্ক উৎপাদনের। ফলে কারখানা হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক। শ্রমবিভাগ সম্ভব শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছে, পক্ষান্তরে গৃহ রয়ে গেছে অবৈজ্ঞানিক এবং এখনও অতিরিক্ত কাজের বোঝায় ন্যুজ মায়েদের মাথায় বিচিত্র ধরনের কাজ চাপিয়ে দেয়া হয়। মুনাফা অর্জন-অভিলাষ প্রাধান্য পাওয়ার স্বাভাবিক ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, মানবিক কর্মকাণ্ডের সেই সব ক্ষেত্রগুলোই সবচেয়ে বেশি এলোমেলো, অসংগঠিত এবং সর্বতোভাবে অসন্তোষজনক যেখান থেকে কোনো প্রকার আর্থিক মুনাফা লাভের আশা নেই।
অবশ্য স্বীকার করতে হবে স্থাপত্যকর্মের সংস্কারের প্রতি সবচেয়ে শক্তিশালী আপত্তি আসবে স্বয়ং শ্রমজীবীদের মনস্তত্ত্ব থেকে। তারা যতই বিবাদ করুক, গৃহকোণেরর নিভৃত সবার পছন্দ এবং তাদের গরিমা ও অধিকারবোধ এতে সন্তুষ্ট হয়। মঠ-আশ্রমের মতো অবিবাহিত গোষ্ঠীজীবনে অনুরূপ সমস্যা দেখা দেয়নি। বিবাহ ও পারিবারিক জীবনই গোপনীয়তা রক্ষার প্রবৃত্তি সূচিত করেছে। আমি মনে করি না যে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য পরিবারের গৃহকোণে রান্না করার বাস্তবিকপক্ষে কোনো দরকার রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি নিজস্ব আসবাবপত্রসহ নিভৃত-গৃহ তাদের জন্য যথেষ্ট যারা এসবে অভ্যস্ত। কিন্তু আন্তরিক অভ্যাস পরিবর্তন সব সময়ই কঠিন। মহিলাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অবশ্য ক্রমে ক্রমে তাদের জীবিকা উপার্জনের জন্য গৃহের বাইরে নিয়ে যাবে এবং এতে আমরা যে ধরনের ব্যবস্থার কথা ভাবছি তা তাদের কাছে কাক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। শ্রমজীবী শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে নারী স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাপারটা এখনও বিকাশের প্রাথমিক স্তরে। তবে এটা বৃদ্ধি পাবে যদি ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা না দেয়। হয়তো এই অভীষ্ট থেকে মহিলারা গোষ্ঠীভিত্তিক রান্নাবান্না পছন্দ করবেন, নার্সারী স্কুলও তাদের পছন্দ হবে। পরিবর্তনের তাড়না পুরুষদের কাছ থেকে আসবে না। শ্রমজীবী পুরুষ, তারা সমাজতন্ত্রী কিংবা ক্যুনিস্ট হলেও, স্ত্রীদের মর্যাদার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পায় না।
বেকারত্ব যেখানে গুরুতর অমঙ্গল হিসেবে রয়ে গেছে, যেখানে অর্থনৈতিক বিধিবিধান উপলব্ধির ব্যর্থতা প্রায় সার্বজনীন, সেখানে মেয়েদের চাকরিতে নিয়োগ ব্যাপারে স্বভাবতই আপত্তি ওঠে। কারণ এতে পুরুষের বেকারত্ব বাড়ে। তাদের চাকুরি মেয়েরা ছিনিয়ে নেয় বলে। এই কারণে বিবাহিত মহিলার সমস্যার সঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা জড়িত এবং এই সমস্যা কিছুটা সমাজতন্ত্র ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। যে যাই হোক, যে সামন্তরিক ক্ষেত্র নির্মাণের পক্ষে আমি ওকালতি করছি তা বৃহদাকারে বাস্তবায়িত করতে হলে বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে করতে হবে। কারণ শুধুমাত্র মুনাফা লোটার অভিপ্রায় থেকে এটা আশা করা যায় না। শিশুর স্বাস্থ্য ও চরিত্র এবং মায়েদের স্নায়ু দুর্ভোগ পোহাতেই থাকবে যতদিন মুনাফা লাভের বাসনা আমাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। কিছু জিনিস অভিপ্রায় দ্বারা অর্জন করা যায়। কিছু জিনিস যায় না; অর্জনে ব্যর্থতার তালিকায় পড়ে শ্রমজীবী শ্রেণির স্ত্রী ও সন্তানদের অবস্থার উন্নয়ন,-এবং যা আরো কাল্পনিক মনে হতে পারে-শহরতলী সুন্দর করা। কিন্তু আমরা যদিও শহরতলীর বিকটতা মার্চের বাতাস কিংবা নভেম্বরের কুয়াশার মতো স্বাভাবিক বলে ধরে নিই, তবু এটা বস্তুত অনুরূপ অনিবার্য নয়। শহরতলীর বাড়ি-ঘরগুলো যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে না-হয়ে পৌরসভা দ্বারা নির্মিত হতো, থাকত পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, কোর্টস অব কলেজের মতো বাড়ি, তাহলে তো কারণ দেখতে পাই না সেগুলো কেন চোখের জন্য আনন্দদায়ক হতো না। উদ্বেগ ও দারিদ্র্যের মতো বিকটতার জন্যও আমাদের মূল্য দিতে হয়। ব্যক্তি-মুনাফার প্রতি দাসত্বের জন্য আমাদের যে মূল্য দিতে হয় এটা তারই অংশ।
০৪. আধুনিক মাইড্যাস
হথর্নের Tanglewood Tales যাদের পড়া আছে তারা মাইড্যাস-এর গোল্ডেন টাচ (সুবর্ণ স্পর্শ)-এর কাহিনী জানেন। এই সার্থকাম রাজার স্বর্ণের প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগ ছিল। ঈশ্বর একে এই বর দিয়েছিলেন যে, তিনি যা স্পর্শ করবেন তাই স্বর্ণে পরিণত হবে। প্রথমে রাজা তো খুবই খুশি। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন ঈপ্সিত খাদ্যবস্তু গলাধঃকরণ করার আগেই কঠিন ধাতুতে পরিণত হয়ে গেল, তখন উদ্বিগ্ন বোধ করতে শুরু করলেন; স্বীয় কন্যাকে চুম্বন করার সঙ্গে-সঙ্গে যখন সে পাষাণে পরিণত হলো তখন তার চক্ষু উঠল কপালে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন ঐ বর ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। ঐ মুহূর্ত থেকে তাঁর এ-ও উপলব্ধি হলো যে জগতে স্বর্ণই শুধু একমাত্র মূল্যবান সামগ্রী নয়।