কৌতূহলী জ্ঞান কেবল অপ্রীতিকর জিনিসকে কম অপ্রীতিকর করে তোলে না। প্রীতিকর জিনিসকে আরো প্রীতিকর করে তোলে। হ্যাঁন রাজত্বের প্রথম দিকে চিনে সর্বপ্রথম পিচ ও অ্যাপ্রিকট ফলের চাষ সূচিত হয়, এই তথ্য জানার পর ঐ দুটি ফলের স্বাদ আমার কাছে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে; মহান রাজা কনিষ্ক চীনের কিছু লোককে জিম্মি করে রাখে, তারা ভারতে উক্ত দুটি ফল চাষের প্রচলন করে, অতঃপর ছড়ায় পারস্যে, সেখান থেকে রোমক সাম্রাজ্যে আসে খ্রিষ্টিয় সনের প্রথম শতাব্দীতে; অ্যাপ্রিকট (Apricot) এবং প্রিকশাস (Precocious) শব্দ দুটির উৎস অভিন্ন, লাতিন, কারণ অ্যাপ্রিকট ফল খুব তাড়াতাড়ি পাকে, এবং শব্দটির আগে A অক্ষর যোগ করা হয়েছিল ভুলক্রমে, শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার দরুন। এসব তথ্য ঐ ফলটিকে আমার কাছে আরো মিষ্টি করে তুলেছে।
প্রায় একশো বছর আগে সুখ্যাত কয়েকজন মানব প্রেমিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কেজো জ্ঞান প্রসারের জন্য, ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে জনগণ অকেজো জ্ঞান আস্বাদনের কথা ভুলে গেছে। বিষণ্ণতার দ্বারা আক্রান্ত আমি একদিন বার্টনের Anatomy of Melancholy বইটি খুলে বসি এবং জানতে পারি যে বিষণ্ণতা নামক একটা বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু যেখানে অনেকে মনে করেন যে এটির জন্মদাতা চারটি কৌতুকরস, পক্ষান্তরে গ্যালেন মনে করেন এর জন্মদাতা তিনটি মাত্র, শ্লেষ্ম কিংবা পিটুইটা এর বহির্ভূত। ভ্যালেরিয়াস এবং মেনারডাস আবার এ দুটিকে অন্তর্ভুক্ত করার দারুণ পক্ষপাতী, এবং ফুসসিয়াস, মন্টালটাস, মন্ট্যানাসও অনুরূপ মতের পৃষ্ঠপোষক। তারা বলেন, সাদা কীভাবে কালো হতে পারে? এই লা-জবাব যুক্তি সত্ত্বেও হারকিউলিস দ্য স্যানিয়া এবং কার্ডান, গুইয়ানেরিয়াস এবং লরেনটিয়াস (বার্টন আমাদের এরকমই বলেন) বিপরীত অভিমত পোষণ করতেন। এই ঐতিহাসিক ভাবনা দ্বারা প্রশান্ত হয়ে আমার বিষণ্ণতা বিলীন হয়ে যায়। এখন বিষণ্ণতার কারণ তিনটি কিংবা চারটি করুণ রস হোক না কেন। অতিরিক্ত আগ্রহের নিদান হিসেবে আমি খুব কম বিষয়ই ভাবতে পারি, যা আলোচিত ধরনের প্রাচীন বিতর্কের চেয়ে বেশি কার্যকরী হবে।
কিন্তু সংস্কৃতির অকিঞ্চিত্বর সুখের যেমন স্থান আছে বাস্তব জীবনের অকিঞ্চিৎকর উদ্বেগ লাঘবের জন্য তেমনি ধ্যানের মূল্য রয়েছে মৃত্যু, ব্যথা, নিষ্ঠুরতা, জাতিসমূহের অন্ধভাবে ছুটে বিপাকে পড়ার মতো জীবনের বৃহত্তর অকল্যাণের ক্ষেত্রে। যারা রীতিবদ্ধ ধর্মে আর কোনো স্বস্তি বোধ করেন না, তাদের জন্য, জীবন যাতে ধূসর, কঠোর এবং তুচ্ছ আত্মজাহিরপূর্ণ না হয়, তার জন্য একটা বিকল্পের দরকার। বর্তমান পৃথিবী কুদ্ধ আত্মকেন্দ্রিক গোষ্ঠীতে পূর্ণ, প্রত্যেক গোষ্ঠী মানব জীবনকে সমগ্রভাবে দেখতে অসমর্থ, কোনো-কোনো গোষ্ঠী সভ্যতার ধ্বংস সাধনে রাজি, তবু এক ইঞ্চি ভূমি ছাড়বে না। এ সংকীর্ণতার মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মহা আয়োজনও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ব্যাপারটা ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের হলে ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতির মধ্যে প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া যাবে। তাছাড়া এমন বিষয়ের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে যেগুলো আত্ম সম্মান খর্ব না-করেও ব্যক্তিকে সমর্থ করে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজকে দেখায়। যা দরকার তা এই তথ্য বা সেই তথ্য নয়, দরকার এমন জ্ঞানের যা গোটা মানব জীবনের লক্ষ্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। দরকার শিল্পকলা ও ইতিহাস, প্রকৃত বীরপুরুষদের জীবনের পরিচয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের অদ্ভুত, আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা। এর সঙ্গে থাকতে হবে যা-কিছু সুস্পষ্টভাবে মানবিক তার প্রতি গর্বের আবেগ, দেখা ও জানার শক্তি, ঔদার্যের সঙ্গে অনুভব এবং বিবেচনার সঙ্গে চিন্তা। ব্যাপক প্রত্যক্ষণ নৈর্ব্যক্তিক আবেগের সঙ্গে যুক্ত হলেই কেবল প্রজ্ঞা দ্রুত উৎসারিত হয়।
জীবন সকল সময়ই যন্ত্রণাকর ছিল, তবে গত দুশো বছরের চেয়ে এখন আরো বেশি যন্ত্রণাকর হয়েছে। যন্ত্রণা থেকে পলায়নের প্রচেষ্টা মানুষকে অকিঞ্চিৎকরতা, আত্মবঞ্চনা এবং বিরাট সমষ্টিগত উপকথা উদ্ভাবনে পরিচালিত করে। তবে এই সব মৌহর্তিক যন্ত্রণালাঘব আখেরে দুর্ভোগের উৎসের সংখ্যা বাড়ায়। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দুর্ভাগ্যের উপর জয়ী হওয়া সম্ভব কেবল একটি প্রক্রিয়ায়, যাতে ইচ্ছা ও বুদ্ধিবৃত্তি পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। ইচ্ছার কাজ হলো অকল্যাণ পরিহার করতে অস্বীকার করা কিংবা অবাস্তব সমাধান গ্রহণে অসম্মতি, বুদ্ধির কাজ হলো ব্যাপারটা অনুধাবন, চিকিৎস্য হলে চিকিৎসার উপায় অনুসন্ধান, প্রকৃত সম্পর্কে স্থাপন করে সহনশীল করে তোলার চেষ্টা করা কিংবা অবশ্যম্ভাবী বলে গ্রহণ করা; এবং স্মরণ করা। আমাদের পরিমণ্ডলের বাইরে কী রয়েছে, পুরাকালে কী ছিল, আন্তঃনাক্ষত্রিক গহ্বরগুলোতে অনুসন্ধান করলে কী পাওয়া যেতে পারে।
০৩. স্থাপত্যকর্ম ও কিছু সামাজিক প্রশ্ন
সেই আদিকাল থেকে স্থাপত্যকর্মের লক্ষ্য দুটি; একদিকে হলো একেবারে উপযোগবাদী, উষ্ণতা ও আশ্রয় যোগানো। অপরদিকে, রাজনৈতিক, পাথরে চমৎকারিত্ব ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের মনে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিস্ময় সৃষ্টি করা। দরিদ্রের জন্য মাথা গোঁজার ঠাই করা গেলেই প্রথম উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়; কিন্তু দেবতাদের মন্দির এবং রাজা-বাদশার প্রাসাদাদির নকশা তৈরি করা হতো আকাশের শক্তি এবং তাদের মতের প্রিয় পাত্রদের প্রীতি ভীতি জন্মানোর জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজা নয়, গোটা সম্প্রদায়কে গৌরবান্বিত করা হতো; এথেন্সের অ্যাপলিস এবং রোমের ক্যাপিটাল ঐসব নগরীর রাজসিকতা প্রদর্শন করত প্রজা এবং মিত্রদের শিক্ষার জন্য। নন্দনতাত্ত্বিক গুণ ঈর্ষণীয় বিবেচনা করা হতো সর্বসাধারণের অট্টালিকায়, এবং পরবর্তীকালে, ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং সম্রাটের প্রাসাদে, কিন্তু কৃষকের পর্ণ কুটীর কিংবা শহুরে লোকদের নড়বড়ে বস্তিতে প্রত্যাশা করা হতো না।