জ্ঞানোপার্জনে সাংস্কৃতিক উপাদান সফলতার সঙ্গে সমন্বিত হলে মানুষের চিন্তার ও বাসনার রূপ গঠন করে। তাদের সংশ্লিষ্ট করে অন্তত বিরাট নৈর্ব্যক্তিক বিষয়াদির সঙ্গে, তার জন্য যা আসন্ন গুরুত্বের শুধু সে সব ব্যাপারের সঙ্গে নয়। তাড়াহুড়ো করে ধারণা করা হয় যে যখন কোনো ব্যক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজের সামর্থ অর্জন করেছে তখন সে তার জ্ঞান শুধু সামাজিক সুফলের জন্য ব্যবহার করবে। শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগী মতবাদ মানুষের লক্ষ্য নির্ণয়ের সঙ্গে-সঙ্গে তার দক্ষতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে চলে। অপ্রশিক্ষিত মানবিক প্রকৃতিতে বিরাট আকারে নিষ্ঠুরতা থাকে, যা ছোট, বড়, নানা উপায়ে প্রকাশ পায়। ছেলেদের স্কুলে নতুন কোনো ছেলের প্রতি নির্দয় আচরণের ঝোঁক থাকে, কিংবা কারো পোশাক-আশাক যদি প্রচলিত ধাঁচের না হয় তাহলে তার প্রতি নির্দয়তা দেখায়। অনেক মহিলা (পুরুষের সংখ্যাও কম নয়) শুধু খোশগল্প করে দ্বেষ ছড়ায়। স্পেন দেশের লোকেরা ষাঁড়ের লড়াই উপভোগ করে; ব্রিটিশরা উপভোগ করে শিকার ও বন্দুক ব্যবহার। একই নির্দয় আবেগ গুরুতর রূপ নেয় জার্মানিতে ইহুদি এবং রাশিয়ায় কুলাক নির্যাতনে। সকল সাম্রাজ্য এ ধরনের কাজের সুযোগ করে দেয়। আর যুদ্ধের সময় এ ধরনের কাজ সর্বোচ্চ জনহিতকর কর্তব্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
এখন, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে অত্যন্ত শিক্ষিত ব্যক্তিও অনেক সময় নির্দয় হয়ে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যাদের মন আকর্ষিত তাদের চেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে নির্দয়তার পরিমাণ কম হয়। স্কুলের একটি গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে শিক্ষার্জনে কম ক্ষেত্রেই গড় দক্ষতা দেখায়। হত্যাকাণ্ড হলে, দেখা যায়, হত্যার মূল নায়কেরা প্রায় ক্ষেত্রেই খুবই অজ্ঞ ব্যক্তি হয়ে থাকে। কারণ এই নয় যে মনন চর্চা সদর্থক মানবিক অনুভূতির জন্ম দেয়। তবে তা দিতেও পারে; কারণ হলো মনন চর্চা প্রতিবেশী নির্যাতনে প্রণোদিত না করে অন্য ক্ষেত্রে উৎসাহী করে, তাছাড়া আধিপত্যের মনোভাব তৈরি না করে, আত্ম-সম্মান অর্জনের ভিন্ন উৎসের দিকে চালিত করে। যে দুটি জিনিস সার্বজনীনভাবে কামনা করা হয় তা হলো ক্ষমতা ও শ্রদ্ধা। অজ্ঞ ব্যক্তি বন্য উপায়ে কেবল যে কোনো একটি অর্জন করতে পারে। এতে পরিবেশের উপর প্রভুত্ব অর্জন অন্তর্ভুক্ত হয়। সংস্কৃতি মানুষকে যে ক্ষমতা দেয় তা কম ক্ষতিকর, এবং এটা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সর্বোকৃষ্ট পন্থা। যে কোনো সম্রাটের চেয়ে গ্যালিলিও বেশি কাজ করেছেন পৃথিবী পরিবর্তন করার জন্য এবং তাঁর ক্ষমতা তার নির্যাতনকারীর ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সুতরাং তার নিজের নির্যাতনকারীতে পরিণত হওয়ার দরকার করেনি।
অকেজো জ্ঞানের সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা এখানে যে এটা মনের চিন্তাশীল অভ্যাসের উন্নয়ন ঘটায়। এই পৃথিবীতে অতি বেশি প্রস্তুতি রয়েছে শুধু কোনো প্রকার পূর্ব চিন্তা ছাড়াই কাজের জন্য, মাঝে মাঝে এমন কাজের জন্যও যে কাজ সম্পর্কে প্রজ্ঞার উপদেশ হবে নিষ্ক্রিয় থাকা। জনগণ এ ব্যাপারে তাদের পক্ষপাত দেখায় নানাভাবে এবং বিশ্রীভাবে। মেফিস্টোফেলিস তার তরুণ ছাত্রদের বলেন যে, তত্ত্ব ধূসর কিন্তু জীবনবৃক্ষ সবুজ এবং সবাই এই উক্তি এমনভাবে উদ্ধৃত করেন যেন এটা গ্যেটের অভিমত, ভেবে দেখা হয় না, গ্যেটের মতে, শয়তান তার প্রাগাতক ছাত্রদের কী বলতে পারে। হ্যামলেটকে দেখানো হয় কাজহীন চিন্তার ভয়ানক সাবধানবাণী হিসেবে, কিন্তু কেউ ওথেলোকে দেখান না চিন্তাহীন কাজের সাবধানবাণী হিসেবে। বার্গসের মতো প্রফেসর, বাস্তববাদী মানুষের প্রতি এক ধরনের স্বপ্নারিবশত দর্শনের নিন্দা করেন এবং বলেন সর্বোৎকৃষ্ট জীবন হবে অগ্রসরমান অশ্বারোহী সৈনিকের অনুরূপ। আমার দিক থেকে বলতে পারি, কাজ সূচিত হবে ব্রহ্মাণ্ড এবং মানবতার অদৃষ্ট সম্পর্কে গভীর বোধ থেকে, বল্গাহীন রোমান্টিক আসক্তি এবং অতিরিক্ত আত্ম-জাহিরের প্রবণতা থেকে নয়। কাজ নয়, চিন্তায় আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অভ্যাস প্রজ্ঞাহীনতা ও অতিরিক্ত ক্ষমতা লিপ্সার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ, দুর্ভাগ্যেও নির্মল স্থৈর্য এবং উদ্বেগের মধ্যে মনের প্রশান্তি রক্ষার উপায়। ব্যক্তিত্বে নিমগ্ন জীবন, আগে হোক পরে হোক, অসহনীয় যন্ত্রণাকর হতে পারে; কেবল বৃহত্তর ও কম বিরক্তিকর বিশ্বের জানলা খোলা রেখে জীবনের হতাশজনক দিক সহনীয় করা যায়।
মনের চিন্তাশীলতা অভ্যাসের সুবিধা একই সঙ্গে অতি-তুচ্ছ এবং অত্যন্ত গভীর। ডানা-হীন ক্ষুদ্রকীট, ট্রেন ধরতে না-পারা কিংবা বদমেজাজী ব্যবসাসঙ্গীর মতো ছোটখাটো বিরক্তিকর ব্যাপার দিয়ে শুরু করা যায়। এই ধরনের বিরক্তি দূর করার জন্য বীরত্বের চমৎকারিত্ব কিংবা মানবীয় অসুস্থতা বিষয়ে গভীর ভাবনা মূল্যহীন বলেই মনে হয়, তবু এ ধরনের ব্যাপার যে বিরক্তি উৎপাদন করে তা অনেকের শিষ্ট মেজাজ বিনষ্ট করে দেয়, জীবনে আনন্দও থাকে না। এসব ঘটনায় অপ্রচলিত জ্ঞান সান্ত্বনা বয়ে আনতে পারে, যার সঙ্গে ঐ মুহূর্তের অসুবিধার প্রকৃত কিংবা কল্পিত সম্পর্ক রয়েছে; এবং কোনো সম্পর্ক না থাকলে একজনের চিন্তা থেকে বর্তমানকে মুছে দেয়। ক্রোধে শ্বেতবর্ণধারণকারী লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হলে দেকার্তের আসক্তি নামক গ্রন্থের কেন তাদের বেশি ভয় করতে হবে যারা ক্রোধে লাল না হয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় অধ্যায়টি স্মরণ করা সুখকর। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন দুরূহ দেখে যারা অধৈর্য বোধ করেন তাদের অধৈর্য হ্রাস পায় যদি তারা সাধু রাজা ৯ম লুই-র কথা ভাবেন, যিনি ধর্ম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে পার্বত্য বুড়ো লোকটার সঙ্গে নিজের শক্তির হিসেব কষে নিয়েছিলেন। এই বুড়ো লোকটিকে আরব্য রজনীতে পাই জগতের অর্ধেক শয়তানীর উৎস হিসেবে। পুঁজিবাদীদের দুর্নিবার লোভ যখন নিষ্পেষণের রূপ নেয় তখন একজন আকস্মিকভাবে সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন এটা স্মরণ করে যে প্রজাতান্ত্রিক পবিত্রতার প্রতিভূ ব্রুটাস একটি নগরীকে ৪০ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিয়েছিলেন এবং যখন ঐ নগরী সুদ প্রদানে ব্যর্থ হয় তখন তিনি সৈন্য ভাড়া করে নগরীটি অবরোধ করেন।