ইবনুল খতীব ও ইবনে খালদুন ছিলেন দুই বন্ধু। সাহিত্যিক পারদর্শিতা এবং ঐতিহাসিক প্রজ্ঞার দিক দিয়ে এঁরা দুইজন পাশ্চাত্য-ইসলামের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি ছিলেন। ইবনুল খতীব উজীর ছিলেন। কোন দরবারী ষড়যন্ত্রের ফলে তিনি ১৩৭১ সালে গ্রানাডা হতে পলায়ন করেন। এর তিন বছর পর ব্যক্তিগত কলহের ফলে কাছ নামক স্থানে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে গ্রানাডা-হয়তো সমস্ত স্পেনই তার শেষ কৃতী সাহিত্যিক, কবি ও রাজনীতিজ্ঞকে হারায়। কবিতা, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, চিকিৎসা প্রভৃতি নানাবিষয়ে তিনি ৬০ খানা বই লেখেন। তার মধ্যে ২০ খানা এখনো পাওয়া যায়। এ সবের মধ্যে গ্রানাডার ইতিহাস আমাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বই।
ইবনে খালদুন তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি মুকাদ্দামার জন্য বিখ্যাত। মুকাদ্দামা ইতিহাসের ভূমিকা বিষয়ক বই। দেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও আবহাওয়া এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি এ সমস্তই যে ইতিহাসের বিকাশ-ধারাকে প্রভাবিত করে, এ মতবাদ তিনিই প্রথম এ পুস্তকে ব্যক্ত করেন। তিনি জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অবনতির আইন খুঁজে বের করতে সাধনা করেছেন। এ হিসেবে তাকে ইতিহাসের প্রকৃত ক্ষেত্র ও প্রাকৃতিক আবিষ্কর্তা বলা চলে। তিনি নিজেও এ দাবী করেছেন। অন্ততঃপক্ষে তাকে সমাজ-বিজ্ঞানের প্রকৃত স্থাপয়িতা বলতেই হবে। ইতিহাসের এমন ব্যাপক ও দার্শনিক ধারণা তার আগে কখনো কোন আরব, এমন কি কোন ইউরোপীয়ানের কল্পনায় আসে নাই। ১৪০৬ সালে ইবনে খালদুনের মৃত্যু হয়। সমস্ত সমালোচক সমবেত কণ্ঠে স্বীকার করেন যে, ইবনে খালদুন ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক দার্শনিকদের অন্যতম ছিলেন।
আরবদের ভৌগোলিক গবেষণা পাশ্চাত্যের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নাই। তবে পৃথিবী যে গোল, তারা এ প্রাচীন ধারণাকে জিইয়ে রাখে। আমরা আগেই বলেছি, হিন্দুদের বিশ্বাস ছিল যে, আমরা পৃথিবীর যে অর্ধাংশকে জানি তার একটা মধ্যবিন্দু বা কেন্দ্র আছে চারদিক হতে এই কেন্দ্র সমদূরে অবস্থিত। ১৯১০ সালে প্রকাশিত একটি ল্যাটিন বইয়ে এই ‘আরিন’ মতবাদ প্রবেশ লাভ করে। এই বই হতে কলম্বাস তাঁর মতবাদ গঠন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী আকারে নাশপতির মত এবং পূর্ব গোলার্ধের ‘আরিন’–এর ঠিক উল্টা দিকে পশ্চিম গোলার্ধেও একটি আরিন আছে।
গ্রহ-বিজ্ঞান ঘটিত ভূগোল ও গণিতের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য-জ্ঞানভাণ্ডারে কয়েকটি নতুন ধারণা দান করা হয়। দশম শতাব্দীর মধ্য ভাগের পর স্পেনে দস্তুরমত গ্রহ-বিজ্ঞানের অধ্যয়ন শুরু হয় এবং কর্ডোভা, সেভিল ও টলেভোর শাসনকর্তারা জ্ঞানের এশাখাকে যথেষ্ট প্রীতির চোখে দেখতে থাকেন। আন্দালুসীয়ার অধিকাংশ গ্রহ-বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করতেন যে, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের বেশীর ভাগ ঘটনার উপরই গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সক্রিয়। এই নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণা হতেই জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ভব হয়। এই শাস্ত্র অনুশীলনের জন্য অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমার হিসেব মোতাবেক পৃথিবীর সকল স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এইরূপে জ্যোতিষশাস্ত্র হতে গ্রহ-বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। ল্যাটিন-পাশ্চাত্য স্পেনের মারফতই প্রাচ্য পণ্ডিতগণ গ্রহ-বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র ঘটিত প্রেরণা লাভ করেন। স্পেনে মুসলমানদের গ্রহ-বিজ্ঞানের প্রধান বইগুলি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ব্রয়োদশ শতাব্দীতে দশম এলফনসো যে এলফোনসাইন নির্ঘন্ট তৈরী করেন, তা আরব গ্রহ-বিজ্ঞানের উন্নত সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরবদের নক্ষত্র বিষয়ক গবেষণার ফলে আমরা তাদের নিকট হতে স্ফিরিকাল ও সরল ত্রিকোণমিতির প্রথম অধ্যায় পেয়েছি। কারণ, এলজাবরা ও বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতির মত ত্রিকোণমিতিও অনেকাংশে আরবরা উদ্ভাবন করে। একটা সাধারণ আকাশ গোলকে যেসব তারার নাম থাকে, তার দিকে একটু চাইলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, আরব গ্রহ-বিজ্ঞানীরা আকাশের গায় তাদের সাধনার অমর-চিহ্ন রেখে গেছেন। ইউরোপীয় ভাষায় তারার যে সব নাম আছে, তার অধিকাংশই আরবী ভাষা হতে উদ্ভূত। যেমন–আকরাম (আকরাব–বিছা), অ্যালগেডী (আল-জোদী-ছাগল ছানা), অ্যালটেয়ার (আল-তায়ের–উড়নেওয়ালা), ডেনের (ধানব–লেজ), ফারকাড (ফারকাদ-বাছুর)। এছাড়া অনেক পরিভাষাও আরবী হতে নেওয়া হয়েছে। যথা : এজিমুথ (আস-সুমুত), নাদির (নাজির), জেনিথ (আল-সামত)। এসব থেকেই স্পষ্টই বোঝা যায় যে, ইসলাম খৃস্টান-ইউরোপকে কি অজস্র দানই না করেছে।
আরবী হতে যেসব গণিত-ঘটিত শব্দ ধার নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে নিতান্ত কৌতূহল-উদ্দীপক একটি শব্দ হচ্ছে, সাইফার বা জিরো (শূন্য)। আরবরা শূন্য আবিষ্কার করে নাই বটে, কিন্তু তারা আরব-সংখ্যার সঙ্গে শূন্য’ ইউরোপে আমদানী করে এবং ইউরোপীয়দের এর ব্যবহার শিক্ষা দেয়। এরই ফলে জীবনের দৈনন্দিন ব্যাপারে গণিতের ব্যবহার সম্ভব হয়।
অমুসলিম-ইউরোপে আরবী সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম ধীরগতিতে বিস্তৃতি লাভ করে। সমস্ত একাদশ, দ্বাদশ এবং এয়োদশ শতাব্দীর কতকাংশ পর্যন্ত খৃস্টান গণিতবিদরা কোমর বেঁধে সেকেলে রোমক সংখ্যা ব্যবহার করতে থাকে; অবশ্য মাঝে মাঝে আপোষ সূত্রে তারা রোমক সংখ্যা ও নতুন আল গোরিজম পাশাপাশি ব্যবহার করত। ইটালীতেই সর্বপ্রথম এই নতুন সংখ্যা ব্যবহারিক জীবনে খাটানো শুরু হয়। পাইসার লিওনার্ডো ফিবোনাকসি মুসলিম ওস্তাদের নিকট শিক্ষালাভ করে উত্তর আফ্রিকায় পরিভ্রমণ করেন। তিনি একখানি বই প্রকাশ করেন। এই বই-ই আরবী সংখ্যা প্রবর্তনে সবচেয়ে বেশী সাহায্যে করে। তারো চেয়ে বড় কথা এই যে, এই বই হতেই ইউরোপীয় গণিত শুরু হয়। পুরাতন সংখ্যার সাহায্য কোন কোন ক্ষেত্রে গণিতের অগ্রগতি অসম্ভব হত । আমরা বর্তমানে যে হিসাব-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত, তার মূলে ছিল আরবী সংখ্যা ও গুণ্য।