এ বিস্ময়কর বিজয়মালাকে আপাতদৃষ্টিতে অপূর্ব বলেই মনে হয়। তবে, এর কারণ নির্ধারণ কঠিন নয় এবং উপরে যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তা থেকেই এর কারণ অনুমান করা চলে। ভিসিয়োগথরা (পশ্চিমী গহ্) খৃস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমভাগে বর্বর টিউটন জাতি হিসেবে স্পেনে প্রবেশ করে। এদের এবং স্পেনীয়-রোমক বাসিন্দাদের মধ্যে বিভেদ-রেখা কোনক্রমেই মুছে ফেলা সম্ভব হয় নাই। সুয়েভী ও ভ্যাঙালরা জার্মানী হতে এসে গধূদের আগে স্পেনে প্রবেশ করে। তাদের উচ্ছেদ করতে ভিসিয়োগধূদের বহুকাল পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে। ভিসিয়োগা একচ্ছত্র এবং কখনো কখনো স্বেচ্ছাচারী রাজারূপে শাসন কাজ চালিয়েছে। তারা বরাবর আরিয়ান সম্প্রদায়ভুক্ত খৃস্টানধর্ম পালন করে চলেছে। অবশেষে ৫৮৭ খৃস্টাব্দে রিকার্ড নামক তাদের একজন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত খৃস্টানধর্ম গ্রহণ করেন। দেশের বাসিন্দারা সবাই ক্যাথলিক ধর্মপন্থী ছিল। ক্যাথলিক ধর্মপন্থী হিসেবে তারা বরাবর অন্য ধর্ম পন্থীদের শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত। বাসিন্দাদের মধ্যে বহুসংখ্যক গোলাম ও ভূমি-দাস ছিল। তারা তাদের এ দুর্ভাগ্যের কলঙ্ক-তিলক ললাটে নিয়ে স্বভাতঃই তুষ্ট ছিল না। এই দাস শ্ৰেণী যদি আক্রমণকারীদের সঙ্গে সহযোগিতা করে তাদের সাফল্য বিধান করে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের কিছুই নাই। তারপর বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল বেশ কিছুসংখ্যক ইহুদী। গথ রাজারা এদের উপর জুলুম করে করে এদের সহানুভূতি হারিয়েছিল। এদের জোর করে খৃস্টান করার চেষ্টা চরমে পৌঁছল তখন, যখন ৬১২ সালে রাজা হুকুম জারী করে বসলেন যে, হয় ইহুদীদের খৃস্টান হতে হবে, না হয় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং তারা নির্বাসিত হবে। এই জন্যই আমরা দেখতে পাই যে, মুসলিম বিজেতারা তাদের স্পেনীয় অভিযানকালে কয়েকটি বিজিত শহর ইহুদীদের হাতে ন্যস্ত করে নিজেরা বাকী অঞ্চল অধিকারে ব্যাপৃত হয়েছেন।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, রাজা ও তাঁর গহ্-বংশীয় আমীর রইসদের মধ্যে রাজনৈতিক মতানৈক্য এবং আত্মকলহ রাষ্ট্রের শক্তি খর্ব করে রেখেছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে গথীয় আমীরেরা বড় বড় ভূখণ্ডের অধীশ্বর হয়ে উঠেছিল। মুসলিম আক্রমণের পূর্ব-মুহূর্তে এই আমীরদের একজন জোর করে দেশের সিংহাসন দখল করে বসেছিলেন। কাজেই সিংহাসনচ্যুত রাজার জ্ঞাতিরা অসঙ্কোচে নতুন রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । উইটিজার সিংহাসনচ্যুত পুত্র অচিলা অকপটে বিশ্বাস করে আসছিলেন যে, আরবরা তারই পক্ষ হয়ে লড়াই করেছে। এলেডো অধিকারকালে উক্ত শহরে তার যে ব্যক্তিগত জমিদারী ছিল, তিনি তা-ই ফেরত পেয়ে তুষ্ট রইলেন এবং এখানে মহাধুমধামে জীবনযাপন করতে লাগলেন। তার পিতৃব্য বিশপ ওপাসকে রাজধানীতে তাঁর স্বপদে বহাল করা হল। সিউটার গভর্নর জুলীয়ান সম্বন্ধে কথিত হয় যে, তিনি আরব নৌ-বাহিনীকে নৌবহর সরবরাহ করেছিলেন। স্পেন বিজয়ে তিনিও অভিনয় করেন; তবে তাঁর অভিনয়ের গুরুত্ব স্পষ্টতঃই অতিরঞ্জিত হয়েছে। ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে যে কয়টি শেষ বাধা ছিল, সারাগোসার পতনে তার একটি দূর হল; কিন্তু পিরেনীজ পর্বত রয়ে গেল। কোন কোন আরব ঐতিহাসিক বলেন যে, মুসা পিরেনীজ অতিক্রম করেছিলন। তিনি নাকি এমন আশাও করেছিলেন সে, ফিরিঙ্গীদের দেশ অতিক্রম করে কনস্টান্টিনোপলের পথে তিনি দামেস্কে খলীফার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবেন। আদতে কিন্তু তিনি কখনো পিরেনীজ পার হন নাই। ইউরোপের ভূগোল সম্বন্ধে আরব আক্রমণকারীদের জ্ঞান স্পষ্ট থাকার কথা নয়। কাজেই ফিরিঙ্গীদের দেশ জয় করে দামেস্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কল্পনা যতই উদ্ভট হোক না কেন, অমন কল্পনা সত্যি তাদের মাথায় প্রবেশ করে থাকতে পারে। মুসার পরবর্তীদের মধ্যে তৃতীয় জন আল-হার ইবনে আব্দুর রহমান আল থাকাফী ৭১৭ কি ৭১৮ সালে প্রথম পিরেনীজ অতিক্রম করেন।
ফ্রান্সের মঠ ও গীর্জার ঐশ্বর্যে প্রলুব্ধ হয়ে এবং মেরোভিনৃজীয়ান দরবারের প্রধান অফিসারদের সঙ্গে একুইটেইন-এর ডিউকদের আত্মকলহের সুযোগে আল-হারু মাঝে মাঝে ফ্রান্সের বুকে অতর্কিত আক্রমণ চালাতে শুরু করেন। তার উত্তরাধিকারী আস্ সামাহ ইবনে মালিক আল-খাওয়ালানী এই আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন। ৭২০ সালে আস-সামাহ্ সেটিমেনীয়া দখল করেন। সেপটিমেনীয়া ভূতপূর্ব ভিসিয়োগথ রাজ্যের একটি সামন্ত প্রদেশ ছিল। অতঃপর তিনি নারবোন অধিকার করে তাকে এক বিশাল কেল্লায় পরিণত করেন এবং বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র এখানে রক্ষিত হয়। কিন্তু পরবর্তী বছর তুলতে তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তুর্ল একুইটেনের ডিউক ইউডিসের রাজধানী ছিল; তার প্রবল প্রতিরোধে মুসলিম বাহিনী পরাভূত হয়। এই সগ্রামে আস-সামাহ্ শহীদ হন। এইরূপে একজন জার্মান রাজপুত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক উল্লেখযোগ্য বিজয় লাভ করেন। পিরেনীজের ওপারে মুসলমানদের পরবর্তী অভিযান সফল হয় নাই।
আস-সামাহ্’র পর আব্দুর-রহমান ইবনে আবদুল্লাহ আল-গাফিকী স্পেনের শাসনকর্তা হন। তিনি উত্তর অঞ্চলে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অভিযান করেন। ৭৩২ খৃস্টাব্দের বসন্তকালের প্রথম ভাগে আব্দুর রহমান পশ্চিম পিরেনীজের পথে অগ্রসর হন। গারোন নদীর তীরে তিনি ডিউক ইউসিকে পরাজিত করেন–বোর্দো আক্রমণ করে এর গীর্জাসমূহে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পয়টিয়ারস্ হয়ে ট্ররস-এর প্রান্তভূমিতে গিয়ে হাজির হন। গলুদের ধর্ম পুরুষ সেন্ট মার্টিনের মাজার হিসেবে টুস গলদের একপ্রকার ধর্মীয় রাজধানী ছিল। এখানে উৎসর্গীকৃত ঐশ্বর্যরাশিই নিঃসন্দেহ রকমে আক্রমণকারীর পক্ষে প্রধান আকর্ষণ ছিল।