এই হিযরত হতেই হযরত মুহম্মদ (সঃ) মক্কার জীবনের অবসান এবং মদীনার জীবনের আরম্ভ। আর এখানেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। অবজ্ঞাত পয়গম্বর হিসেবে তাঁর মাতৃভূমি ত্যাগ করে সম্মানিত নেতা হিসেবে তিনি তাঁর নব আবাস-নগরে প্রবেশ করেন। তার ভিতরের দ্রষ্টা জীবনের পার্শ্বে জেগে ওঠে–আর জেগে ওঠে তার সাথে জ্ঞান গরীয়ান এক কর্মী পুরুষ।
এই সময় একটি গ্রীষ্মকালীন সওদাগরী কাফেলা সিরিয়া হতে মক্কায় ফিরে আসছিল। মদীনার উপকণ্ঠে মুসলমানদের দ্বারা এই কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার গুজব রটে। মক্কা ছিল তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী। সুতরাং এই আক্রমণ সে রাজধানীর বাণিজ্যিক জীবনের মর্মমূলে নিদারুণ আঘাত হানে। কাফেলার সর্দার এ আক্রমণ-অভিসন্ধির কথা আগেই জানতে পেরে মক্কার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিল। ফলে যে যুদ্ধ হয়, তাতে তিনশ’ মুসলমান তাদের পয়গম্বরের অনুপ্রেরণাময় নেতৃত্বে এক হাজার মক্কাবাসীকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে। সামরিক ব্যাপার হিসেবে এ যুদ্ধ যতই নগণ্য হোক না কেন, এই-ই হয়ে পড়ল হযরত মুহম্মদের (সঃ) পার্থিব ক্ষমতার বুনিয়াদ। প্রকাশ্য যুদ্ধে ইসলাম এই তার প্রথম এবং নিশ্চিত বিজয় লাভ করল। তারা ভাবল, ইসলাম যে আল্লাহ্র মনোনীত ধর্ম, এ বিজয় তারই প্রমাণ।
এ যুদ্ধে মুসলমানেরা নিয়মের প্রতি যে নিষ্ঠা এবং মৃত্যুর প্রতি যে অবজ্ঞার পরিচয় দিল, পরবর্তী এবং বৃহত্তর বিজয়কালে এই-ই হয়ে উঠেছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। সত্য বটে, পর বছর মক্কীরা এসে তাদের প্রতিহিংসা সাধন করে গেল, পয়গম্বর স্বয়ং আহত হলেন; কিন্তু তাদের এ বিজয় স্থায়ী হল না। ইসলাম তার শক্তি পুনরুদ্ধার করে নিল এবং আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হতে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের আসরে নেমে এল। তার প্রচার অনিরুদ্ধভাবে এগিয়ে চলল। এযাবতকাল পর্যন্ত ইসলাম রাষ্ট্রের ভিতরের ধর্ম ছিল। মদীনায় ইসলাম রাষ্ট্র-ধর্মের সীমা অতিক্রম করে চলে গেল : ইসলাম এখন নিজেই রাষ্ট্র হয়ে বসল। এই সময় হতে জগত ইসলামকে এই নবরূপেই চিনে আসছে : একটি রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা।
ইহুদীরা মুসলমানদের দুশমনগণের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, এই জন্য অতঃপর হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন। তাদের নেতৃস্থানীয় কওমের ছয়শ’ লোক নিহত হল; বাকী সবাইকে বহিষ্কৃত করে দেওয়া হল। এর ফলে যে সব খেজুর বাগান মালিকহীন হয়ে পড়ল, সেখানে মুহাজিরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হল। ইসলামের দুশমনদের মধ্যে এই-ই হল প্রথম কওম, যাদের সম্পর্কে চরম ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল।
এই মদীনা-যুগে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইসলামকে আরবের জাতীয় ধর্মে পরিণত করলেন। তিনি ইহুদী ও খৃস্টানদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। সাথে ‘র বদলে শুক্রবারকে মনোনীত করা হল। ঘণ্টাধ্বনি ও তূর্যনাদের পরিবর্তে মিনার হতে আযান দেওয়ার ব্যবস্থা হল। রমযান মাসকে রোজার মাস গণ্য করা হল। নামাজের জন্য কিবৃলা বায়তুল মোকাদ্দেস হতে কাবার দিকে পরির্তন করা হল; মক্কায় তীর্থ গমন সিদ্ধ করা হল এবং প্রাক-ইসলামী যুগের পূজ্য কালো-পাথরকে চুমা দেওয়া জায়েজ করা হল।
৬২৮ সালে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ১৪০০ মুমিন নিয়ে মক্কায় হাজির হন এবং একটি সন্ধি-পত্র আদায় করেন। এতে মক্কী ও মুসলমানদের প্রতি সমান ব্যবহারের শর্ত লিপিবদ্ধ হয়। এই সন্ধি দ্বারা হযরত মুহম্মদ (সঃ) ও তার আপনজন কোরায়েশদের ভিতরের দ্বন্দ্বের কার্যতঃ অবসান ঘটে। এই সময় খালিদ-ইবনুল-ওলীদ এবং আমর-ইবনুল-আস ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালের অভিযানে এঁরা দুজনেই হয়ে ওঠেন ইসলামের দুর্জয় তরবারি। এর দুই বছর পর ৬৩০ সালের জানুয়ারীর শেষ ভাগে (৮ম হিজুরী) মক্কা বিজয় পরিপূর্ণ হয়। শোনা যায়, এ সময় কাবা ঘরে তিনশ ষাটটি প্রতিমা ছিল। হযরত মুহম্মদ (সঃ) তার অনেকগুলি ভেঙ্গে ফেলেন এবং ঘোষণা করেন : “সত্য এসেছে আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।” মক্কাবাসীদের সঙ্গে ব্যবহারে তিনি মহানুভবতার এক অপূর্ব আদর্শ দেখালেন–প্রাচীন জগতের ইতিহাসে এমন বিজয়-প্রবেশের তুলনা নাই বল্লেই চলে।
সম্ভবতঃ এই সময়ই হযরত মুহম্মদ (সঃ) কাবার চারপাশের স্থানকে নিষিদ্ধ ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেন। এ সম্বন্ধে একটি ওহীও নাজেল হয়। পরবর্তীকালে এই ওহীর ব্যাখ্যাস্বরূপ বলা হয় যে, অমুসলমানের পক্ষে কাবার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্পষ্টই মনে হয়, এ আয়াতে হজের সময় পৌত্তলিকদের কাবার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়; কিন্তু আয়াতটির পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা আজো মেনে চলা হয়। এ পর্যন্ত পরজনের মত ইউরোপীয়-খৃস্টান মক্কা-মদীনা দেখে কোনরকমে জান নিয়ে ফিরে এসেছে। প্রথম জন ছিলেন বলোগনার লুডোভিসো-ডি-বার্থেমা, (১৫০৩); সর্বশেষদের মধ্যে ছিলেন এলডন রাটার নাম ইংরেজ। অবশ্য স্যার রিচার্ড বার্টানের বর্ণনাই সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক।
৯ম হিজরীতে আকাবার খৃস্টান-প্রধান এবং মানা, আদরু ও জারবা মরূদ্যানের ইহুদী কওমদের সাথে হযরত মুহম্মদ (সঃ) সন্ধি স্থাপন করেন। দেশীয় খৃস্টান ও ইহুদীগণকে জিমীরূপে আশ্রয় দেওয়া হয়; বদলে তারা জিজীয়া দিতে রাজী হয়। জমি ও মাথা উভয়ের খাজনাই জিজীয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নজীর পরবর্তীকালে অনেক সুদূরপ্রসারী ফল প্রসব করে।