আইয়ামে জাহেলীয়ার যুগে কেবল এই কবিত্বময় প্রকাশ-ভঙ্গীতেই আরবরা দক্ষতা অর্জন করেছিল। কবিতা-প্রিয়তাই ছিল বেদুঈনের একমাত্র সাংস্কৃতিক সম্পদ।
কবির মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার অনেকগুলি কাজ জুটে যায়। লড়াই’র ময়দানে তার কওমের সাহসিকতার মত তার জিহ্বাও কার্যকরী ছিল। শান্তির সময় কবি তার অগ্নিময়ী বক্তৃতা দ্বারা শান্তি ভঙ্গের কারণ হয়ে উঠতে পারতেন। বর্তমান রাজনৈতিক অভিযানে কোন তুখোড় বক্তা যেমন প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণ করে কলহের সূত্রপাত করতে পারে, তেমনি আরবের কবি তার কবিতা দিয়ে কোন কওমকে উত্তেজিত করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে পারেন। সেকালে কবিই ছিলেন মরু-সমাজের প্রেস এজেন্ট ও সাংবাদিক। কাজেই অনেক সময় বহু অর্থ দিয়ে তাকে তুষ্ট রাখা হত। তাঁর কবিতা লোকে মুখস্থ করত। তারপর সে কবিতা একজনের নিকট হতে অন্যজনে শিখে নিত। এমনিভাবে সে কবিতা প্রচারণার এক মস্ত যন্ত্র হয়ে পড়ত। কবিরা জনসাধারণের অভিমতও গঠন করতেন। প্রাচীনকাল হতে কবির জিভ কেটে ফেলা মানে ছিল কবিকে পয়সা কড়ি দিয়ে তার বিদ্রুপাত্মক কবিতা হতে রেহাই পাওয়া।
কবি, তার সমাজের কেবল যে দৈববাণী দাতা, পথ-প্রদর্শক, বাগ্মী ও মুখপাত্র ছিলেন এমন নয়, তিনি তাঁর সমাজের ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকও ছিলেন–অবশ্য সেকালে যতখানি বৈজ্ঞানিক হওয়া সম্ভব ছিল। বেদুঈনেরা কবিতা দিয়ে বুদ্ধির পরিমাপ করত । এক কবি দাবী করেছেন : ‘আমার কওমের সঙ্গে যুঝতে আসবে, এমন দুঃসাহস কার?’….
ঘোড়-সওয়ার, কবি ও জন-বল এমন আর কার আছে? কওমের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল এই তিন চীজে : সামরিক শক্তি, বুদ্ধি ও জনবল।
কাব্যগত মূল্য ও সৌন্দর্য সুষমা ছাড়াও প্রাচীন আরবী কবিতার আরো একটি দাম আছে? যে যুগে এই সব কবিতা রচিত হয়েছিল সে যুগের ঐতিহাসিক উপকরণ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে এই-ই আমাদের আধ-সমসাময়িক ঐতিহাসিক মাল-মসলা। এর থেকে প্রাক-ইসলামী সমাজের সর্বাবস্থা সম্বন্ধেই আলোক পাওয়া যায়। এই জন্য আরবে প্রবাদ আছে কবিতা আরবের পাবলিক রেজিস্টার।
আইয়ামে জাহেলীয়ার বেদুঈনদের কবিতা দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, হযরত মুহম্মদের (সঃ) আগে বেদুঈনদের যদি কোন ধর্ম থেকে থাকে তা সামান্যই ছিল। ঐতিহ্যের প্রতি বেদুঈনের সনাতন শ্রদ্ধাই ছিল তার ধর্মসংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের মূল উৎস। কোন খানেই সেকালের কোন দেব-দেবীর প্রতি প্রকৃত ভক্তি কোন পরিচয় আমরা পাই না। বেদুঈন বিশ্বাস করত, মরুভূমিতে জীন নামক কতকগুলি পশু-প্রকৃতির জীব বাস করে। দেব-দেবীর সঙ্গে জীনদের একমাত্র এই তফাৎ ছিল যে, দেব-দেবীরা মোটের উপর মানুষের হিতৈষী আর জীনেরা মানুষের দুশমন। বাস্তবিক, মরুর অজানিত বিভীষিকা ও বন্য জীব জন্তুর আতঙ্ককেই কাল্পনিক রূপ দিয়ে এই সব জীন পয়দা করা হয়েছিল। ইসলামের পরও জীন সম্বন্ধীয় ধারণা মরে যায় নাই; বরং জীনের সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ পৌত্তলিক মুগের দেব-দেবীকে স্থানচ্যুত করে জীনে পরিণত করা হয়।
হেজাজ প্রদেশ নদের উচ্চভূমি ও সমুদ্র উপকূলের নিম্নভূমিকে আলাদা করে রেখেছে। এই অনুর্বর প্রদেশে অবস্থিত মক্কা নগর। মক্কা নগরে একটি (একমাত্র নয়) উপাস্য দেবতা ছিল, নাম আল্লাহ্। অতি পুরাতন এ নাম। মক্কার বাসিন্দারা বিশ্বাস করত, আল্লাহ্ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং বিপদে ত্রাণকর্তা। এক্ষণে অনতিকাল মধ্যে এই মক্কার একটি মানুষের মুখ হতে ধ্বনিত হল আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠতম শব্দ, যে জীবনময়ী বিপুল ধ্বনি মরুবাসীদের তাদের সংকীর্ন দ্বীপবাস হতে তল্কালীন ধরণীর প্রায় শেষ সীমা পর্যন্ত নিয়ে পৌঁছিয়ে ছিল : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আল্লাহ ছাড়া আর উপাস্য নাই।
০৪. মুহম্মদ-রসূলুল্লাহ (সঃ)
তখন মক্কার অন্তর্গত কাবা ছিল বহু রকম দেব-দেবীর মন্দির এবং মক্কা ছিল তীর্থের এক মস্ত কেন্দ্র। কোরায়েশ কওম এই কাবার রক্ষক ও সেবায়েত ছিল। অভিজাত কওম হিসেবে কোরায়েশের ইজ্জতের অন্ত ছিল না। ৫৭১ খৃষ্টাব্দ বা তার কাছাকাছি সময়ে এই কোরায়েশ কওমে একটি শিশুর জন্ম হয়।
সূতিকাগৃহেই তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল মুহম্মদ–স্পষ্টতঃই সম্মান-বাচক উপাধি। কোরআনে তার নাম দেখতে পাই মুহম্মদ (সঃ) এবং একবার আহমদ। এ নামের মানে বিশেষ প্রশংসিত। দুনিয়ায় এ নামে যত শিশু-পুত্র আছে, অন্য কোন নামে তেমন নাই। তাঁর কওম তাঁর নাম দিয়েছিল আল-আমিন (বিশ্বস্ত)। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তার বয়স যখন ছয় বছর সেই সময় তাঁর মাতাও ইন্তিকাল করেন।
বিশ্ব-নবীদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইতিহাসের পূর্ণ আলোকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। পঁচিশ বছর বয়সে ধনবতী ও উচ্চমনা বিধবা খাদীজার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। খাদীজা বয়সে তার চেয়ে পনর বছর বড় ছিলেন। এই সময় হতেই হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইতিহাসের স্পষ্ট মঞ্চে এসে হাজির হলেন। খাদীজা কোরায়েশ খান্দানের মূনী ছিলেন। তিনি এক ধনী সওদাগরের বিধবা পত্নী ছিলেন এবং স্বাধীনভাবে তার কারবার পরিচালনা করে আসছিলেন। যুবক হযরত মুহম্মদকে (সঃ) তিনি তাঁর কাজে নিযুক্ত করেন। যতদিন পর্যন্ত এই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ম য়সী নারী জীবিত ছিলেন, ততদিন হযরত মুহম্মদ (সঃ) অন্য বিয়ের কথা চিন্তা করেন নাই।