থুথু না ফেলে সে গিলে ফেললো। তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে একথা জানতে পারলে হ্যারি আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা খুশি হয়ে উঠবে। পেছন থেকে সালি আর অ্যান্টন হাসছে। হ্যারিকে না দেখেও কনর তার চেহারার ভঙ্গিটা আন্দাজ করতে পারছে। সে জানে এখন হ্যারি আমুদে গলায় কী বলবে। ও বড়োদের গলা খুব ভালোভাবে নকল করতে জানে।
‘দেখেশুনে চলো, নাহলে তো পড়ে যাবে।’ হ্যারি বললো।
হ্যাঁ, এটাই বলবে!
কিন্তু আগে এমনটা ছিল না।
হ্যারি সব শিক্ষকদের পছন্দের ছাত্র, সোনালি চুলের দারুণ এক ছেলে। ফুটবল পিচের সবচেয়ে দ্রুতগামী খেলোয়াড়। কিন্তু কনরের কাছে সে তার ক্লাসের আর অন্য দশটা ছেলের মতোই। দুজনকে ঠিক বন্ধু বলা চলে না। হ্যারির আসলে কোনো বন্ধু নেই, কেবল কিছু ভক্ত আছে। সে যাই করে না কেন অ্যান্টন আর সালি কেবল তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসে তাদের সাথেও কনরের শত্রুতা নেই। হ্যারি হয়তো ঠিকমতো কনরের নামও জানতো না।
গত বছরের মাঝামাঝির দিকে সবকিছু বদলে যায়। কনর হ্যারির নজরে পড়ে। তখন থেকে যেন সে হ্যারির বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
কনরের মায়ের ব্যাপারটার সাথে সাথেই এসব শুরু হয়নি। আরও পরের ঘটনা। দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই হ্যারির ফাজলামো শুরু হয়। ওই বৃক্ষদানবের স্বপ্ন না। আসল দুঃস্বপ্ন, যার কথা কনর কখনও কাউকে বলবে না। সেই দুঃস্বপ্ন শুরুর পর থেকেই হ্যারি তাকে লক্ষ করা শুরু করে। যেন কনরের গায়ে এমন কোনো দাগ লেগে আছে যেটা হ্যারিই দেখতে পায়।
সম্ভবত এই দাগই হ্যারিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে।
নতুন বছরের শুরুর দিন হ্যারি ইচ্ছে করে কনরকে মাঠে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সেখান থেকেই এসবের শুরু।
তার পর থেকে এমনটা প্রতিদিনই হয়।
অ্যান্টন আর সালির হাসি শুনেও কনর ঘুরে দাঁড়ালো না। জিভ দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো, ঠোঁট বেশি কাটেনি। তখনই আরেকটা ব্যাপার ঘটে গেল।
‘ওকে ছেড়ে দাও।’ কনর শুনতে পেল।
ঘুরে দেখলো, লিলি এন্ড্রুস হ্যারির মাথায় জোরে ঠোকর মারছে। তাতে যেন সালি আর এন্টনের হাসি আরও বেড়ে গেল।
‘তোমার ছোটো কুকুরটা তোমাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে।’ অ্যান্টন বললো।
‘কারে। সাথে লাগতে এলে এইভাবে কেন আগাবে?’ লিলি চিৎকার করলো। কোঁকড়ানো চুলগুলো ঝাঁকাতে লাগলো।
‘তোমার তো রক্ত পড়ছে ও’ম্যালি।’ লিলিকে উপেক্ষা করে হ্যারি শান্ত কণ্ঠে বলে।
কনর মুখে হাত দিয়ে দেখলো, ঠোঁটের কোণ দিয়েও রক্ত পড়ছে।
‘ওর টেকো মা চুমু দিয়ে দিলেই এটা ঠিক হয়ে যাবে।’ সালি ব্যঙ্গ করলো।
কনরের মনে হলো তার মাথার ভেতরে বুঝি আগুন লেগে গেছে, রাগে পাগল হয়ে কিছু করার আগেই লিলি গর্জে উঠে সালিকে জোরে ধাক্কা মেরে কাদামাটিতে ফেলে দিলো ।
‘লিলিয়ান এন্ড্রুস।’ মাঠের ওপাশ থেকে একটা রাগী গলা গর্জে ওঠে।
সবাই থমকে গেছে, এমনকি উঠতে যাওয়া সালিও। তাদের শিক্ষক মিস ওয়ান রেগেমেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। মহিলার মুখ রাগে জ্বলজ্বল করছে।
‘ওরাই এসব শুরু করেছিল মিস।’ লিলি বললো।
‘আমি এসব শুনতে চাই না।’ মিস ওয়ান বললেন, ‘তুমি ঠিক আছো সালিভান?’ সালি একবার লিলির দিকে তাকিয়ে ব্যাথা পাবার ভান করে। ‘আমি জানি না মিস, মনে হচ্ছে বাসায় চলে যেতে হবে আমার।’
‘এত ঢঙের দরকার নেই।’ মিস ওয়ান বললেন, ‘আমার অফিসে চলো, লিলিয়ান।’
‘কিন্তু মিস, ওরা…’
‘এখনই চলো, লিলিয়ান।’
‘ওরা কনরের মাকে নিয়ে ঠাট্টা করছিল।’
আবারও সবাই থমকে গেল, কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।
…আর তার চোখে দুঃস্বপ্নটা ভেসে উঠলো, বাতাসের গর্জন, তীব্র অন্ধকার…
ভাবনাটা দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো সে।
‘কনর, এটা কি সত্যি?’ মিস ওয়ান গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
মুখে রক্তের স্বাদে বমি চলে আসছে কনরের। হ্যারিদের দিকে তাকালো সে, অ্যান্টন আর সালিকে চিন্তিত দেখালেও হ্যারি নির্লিপ্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
যেন কনরের মুখ থেকে আসল কথা জানার জন্যে অপেক্ষা করছে।
‘না মিস, এটা সত্যি না। আমি পড়ে গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে উঠতে সাহায্য করছিল।
লিলির চেহারায় আহত ছাপ ফুটে উঠে ক্রমেই সেটা বিস্ময়ের রূপ নিলো।
‘যার যার ক্লাসে ফিরে যাও। লিলিয়ান আমার সাথে চলো।’
লিলি মিস ওয়ানের সাথে চলে যাওয়ার সময় কনরের দিকে তাকালো। কিন্তু কনর সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
‘ভালো করেছ, ও’ম্যালি।’ হ্যারি বললো।
কনর কিছু না বলে ব্যাগটা তুলে নিলো। তারপর ভেতরে চলে গেল।
গল্প
গল্প। বাড়ি ফেরার সময় গল্পের কথা ভাবছে কনর।
স্কুলে সারাদিন সে হ্যারি আর তার চ্যালাপ্যালার থেকে দূরেই ছিল, পাছে আবার কোন ‘দুর্ঘটনা’ ঘটে যায়। এদিকে কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ক্লাসে আসা লিলিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছে সে। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই সে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে গেছে। এখন বাসায় যেতে যেতে যেন হ্যারি, লিলি আর স্কুলের ভারে কাঁধটা ভারী লাগছে তার।
গল্প। কনর আবারও ভাবলো।
‘তোমাদের গল্প।’ মিসেস মার্ল ইংলিশ ক্লাসে বলেছিলেন, ‘এমন ভেবো না যে তোমাদের জীবনে বলার মতো কোনো গল্প নেই।’
জীবনগাথা নামে উনি নতুন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। এবার না-কি ওদের জীবনের গল্প লিখতে হবে। নিজেদের পরিবার, বাসা, ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া বা ভালো কোনো স্মৃতির ব্যাপারে ।